৩ জুন ২০১৭, শনিবার, ১০:৪৩

এদেশে দেবি ও ওদেশে গরু প্রসঙ্গ

|| আশিকুল হামিদ || আওয়ামী দেবি এবং বিজেপির গরু নিয়ে সম্প্রতি দেশের সকল মহলে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। সত্যি বলতে কি, আলোচনার আড়ালে বিতর্ক এবং নিন্দা-সমালোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। সর্বশেষ উসকানির কারণে সম্প্রতি সে আলোচনাই অনেক শক্তিশালী হয়ে প্রাধান্যে এসেছে। ভারতের গরু বিতর্ক সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। কারণ, হিন্দুদের দেবি গরুর ব্যাপারে ভারতীয়দের আবেগের কোনো শেষ নেই। সে গরুকেই মুসলমানরা তো বটেই আজকাল আবার খোদ হিন্দুদেরও বিশাল এক অংশসহ অন্য ভারতীয়রাও রসিয়ে রসিয়ে চিবিয়ে খেতে শুরু করেছে। অথচ ক্ষমতায় রয়েছে সবচেয়ে উগ্র এবং নামকরা হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। এমন অবস্থা চলতে পারে না বলেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদীর সরকার এক নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। এর ফলে একই সঙ্গে বাংলাদেশে দেবি এবং ভারতে গরু বিষয়ক আলোচনার তুফান বইতে শুরু করেছে।
প্রথমে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবি থেমিসের মূর্তি নিয়ে আলোচনায় মোড় ঘুরিয়েছে সরকারের একটি রহস্যময় পদক্ষেপ। মূর্তিটিকে সম্প্রতি হঠাৎ রাতের অন্ধকারে সরিয়ে সুপ্রিম কোর্টেরই অ্যানেক্স ভবনে বসানো হয়েছে। অন্তরালের রাজনীতি প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেনের কিছু বক্তব্য এবং মন্তব্য স্মরণ করা দরকার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, শিল্পের বিচারে দেবি থেমিসের নামে স্থাপিত মূর্তিটি শুধু নয়, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ভাস্কর্য নামের ৯০ শতাংশ মূর্তিকেই সরিয়ে নেয়া উচিত। কারণ, এগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের এবং লজ্জাজনক। রাজধানীর অধিকাংশ সড়কদ্বীপ, রাস্তার ওপরে এবং রাস্তার মধ্যে যেসব ভাস্কর্য আছে সেগুলোর অধিকাংশই এত নিম্ন মানের ও কুরুচিপূর্ণ যে, কোনোটির দিকে তাকানো পর্যন্ত যায় না।
ডিন নিসার হোসেনের কথাগুলোকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে। স্বীকারও করতে হবে, বিশেষ করে গ্রিক দেবি থেমিসের নামে স্থাপিত ও বহুল আলোচিত মূর্তিটি আদৌ কোনো শিল্পকর্ম ছিল না। ছিল কুরুচিপূর্ণ ও নিম্ন মানের একটি বিচিত্র ধরনের নারী মূর্তি মাত্র। নামে গ্রিক দেবি বলা হলেও তাকেই শাড়ি পরিয়ে ‘বাঙালি’ নারী হিসেবে পরিচিতি দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। সে নারীও আবার যেন-তেন নারী নয়, তার হাতে একখানা তলোয়ারও ধরিয়ে দিয়েছিলেন শিল্পী মৃনাল হক! পাঠকরা ঠান্ডা মাথায় এমন একজন ‘বাঙালি’ নারীর কথা কল্পনা করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন, যার চেহারা ও উন্নত বক্ষদেশ কথিত এক গ্রিক দেবির মতো, কিন্তু সে একই নারী অতি আধুনিকা এবং মডেল কন্যাদের ঢঙে শাড়ি পরে আছে! এক হাতে তার ন্যায়বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা এবং অন্য হাতে তলোয়ার, যা দিয়ে সে হত্যার মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি নিশ্চিত করবে! এজন্যই বলা হয়েছে, ফাজলামোরও সীমা থাকা উচিত।
কিন্তু ওই সীমা রাখেননি তারা, মূর্তিটিকে যারা সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপন করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে এত বেশি বিতর্ক, নিন্দা-সমালোচনা এবং ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে যে, নতুন করে আর কিছু বলার তেমন অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও কিছু বলতেই হবে- যার উপলক্ষ তৈরি করেছেন সেই বিশেষ গোষ্ঠীর লোকজন- বাংলাদেশকে যারা নিজেদের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করেন। এদিকে গ্রিসের ঢাকাস্থ দূতাবাসের কর্মকর্তারা কিন্তু অন্য খবর জানিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে রাতের অন্ধকারে মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার পর তারা বলেছেন, গ্রিসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে নাকি ৩০ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে সরকার যদি মূর্তিটি অপসারণ না করতো তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে গ্রিস আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতো। মামলা করার কারণও উল্লেখ করেছেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। বলেছেন- প্রথমত, যে মূর্তিটিকে গ্রিক দেবি থেমিস নাম দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে সেটা আসলে ওই দেবির ধারে-কাছেও যেতে পারেনি। ভাস্কর্য হিসেবেও ওটা অত্যন্ত নিম্ন মানের। তাছাড়া গ্রিক দেবি কেন বাঙালি এবং ভারতীয়দের মতো শাড়ি পরতে যাবে? শুধু গ্রিকরা কেন, ইউরোপের অন্য কোনো দেশের নারীরাও তো শাড়ি পরে না। শাড়ি নয়, তাদের পোশাক শার্ট-প্যান্ট এবং স্কার্ট ও টপ্স। যেসব দেশের নারীরা ওই ধরনের পোশাক পরে থাকে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসের বিচারে গ্রিস তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রিকরা অন্যদের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠও ভেবে থাকে। তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে প্রবল রকমের অহংকার বা জাত্যাভিমানও রয়েছে।
সেই গ্রিকদের একজন দেবির নামেই সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। উন্নত বক্ষদেশসহ তার শাড়ি পরার ধরন তো বটেই, হাতের তলোয়ারও গ্রিসের জনগণ এবং সরকারকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কারণ, শিক্ষিত ও সভ্য জাতি হিসেবে গ্রিকদের জন্য দাঁড়িপাল্লা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দেবি থেমিস একাই যথেষ্ট। ওই দেবিকেই তারা ন্যায়বিচারের প্রতীক মনে করে। তলোয়ার তো বর্বর এবং অশিক্ষিত জাতিরা ব্যবহার করবে। ভদ্র এবং শিক্ষিত বলেই গ্রিস দূতাবাসের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেননি। তবে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে আপত্তি ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে তাদের দেশ জাতিসংঘের কাছে নালিশ করেছে। জাতিসংঘও বাংলাদেশ সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে মূর্তিটিকে সরানো না হলে একদিকে গ্রিসের সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতো, অন্যদিকে জাতিসংঘ নিতো তার নিজের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা। বলা বাহুল্য, এসবের কোনো একটির ফলাফলই বাংলাদেশের পক্ষে আসতো না। বাংলাদেশকে বরং বিশ্বের কাছে অতি লজ্জাকর পরিচয়ে পরিচিত হতে হতো- এমন এক অসভ্য দেশ হিসেবে, যে দেশের সরকার এবং জনগণ ইতিহাসও জানে না! তারা এমনকি অন্য কোনো দেশ এবং সে দেশের মানুষের মেনে চলা ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানো শেখেনি।
বলা দরকার, আওয়ামী লীগ সরকার কিন্তু গ্রিসের প্রতিবাদ এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে মামলার হুমকির মতো কোনো একটি বিষয়েই জনগণকে জানতে দেয়নি। সরকার বরং পুরো বিষয়টিকে নিয়েই রীতিমতো তামাশাপূর্ণ পলিটিক্স করে এসেছে। করেছেও আবার প্রথম থেকেই। যেমন গত বছরের ডিসেম্বরে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল রাতের অন্ধকারেÑ যাকে বলে ‘চোরের মতো’ কম্ম করেছিলেন সংশ্লিষ্টজনেরা। ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে এত জায়গা থাকা সত্ত্বেও বেছে বেছে সুপ্রিম কোর্টের সামনে এনে স্থাপন করার পেছনেও সরকারের অশুভ উদ্দেশ্য আড়াল করা যায়নি। ওটা এমন এক স্থান, যার ঠিক পাশেই বাংলাদেশের জাতীয় ঈদগাহ ময়দান অবস্থিত। তারও পশ্চিমে রয়েছে হাইকোর্ট মাজার। সব মিলিয়েই জনগণের ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতিকে আঘাত করতে চেয়েছিল সরকার। অন্তরালে ছিল সাম্প্রদায়িক সংঘাতের জন্য উসকানি দেয়ার স্পষ্ট উদ্দেশ্য। কথাটা বলা হচ্ছে এজন্য যে, স্বাভাবিক অবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতীক হিসেবে একটি নারী মূর্তি অন্তত স্থাপন করার প্রশ্ন উঠতে পারে না। এর কারণ, সংশোধনীর নামে দফায় দফায় যথেচ্ছভাবে কাটাছেঁড়া করা হলেও বাংলাদেশে এখনো একটি সংবিধান রয়েছে। সে সংবিধানে ন্যায়বিচার যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে তেমনি নির্দেশনা রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারেও। সুতরাং এসব বিষয়ে ‘জানান’ দেয়ার দরকার পড়ে না। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ‘জানান’ দেয়ার ব্যবস্থাই করেছিল।
সরকারের উদ্দেশ্যও যে অতি ভয়ংকরই ছিল সে সম্পর্কে শুরুতে যেমন এখনো তেমনি নানা তথ্য ও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাম্প্রদায়িক সংঘাতের উসকানি দেয়া ছিল সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। সরকারের ভেতরের নীতি নির্ধারকরা ভেবেছিলেন, গ্রিক দেবির দেখা যায় কি যায় না ধরনের মূর্তি স্থাপন করা হলেই ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমানের দেশে প্রতিবাদ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবেন কথিত ইসলামী মৌলবাদীরা। ২০১৩ সালের মে মাসে বায়তুল মোকাররমের আশপাশের এলাকায় নিজেরা ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালিয়েও হেফাজতে ইসলামের ওপর দোষ চাপানোর কৌশল কাজে দিয়েছিল বলে সরকার এবার গ্রিক দেবিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পাশাপাশি গ্রিস ও ইতালীর মতো সভ্য দেশগুলোকেও জড়িয়ে ফেলা। ওদিকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের প্রধান নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো রয়েছেই, রয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আরেক রাষ্ট্র ভারতও। সুতরাং দেশের মৌলবাদীরা মিছিল-সমাবেশের মতো সামান্য কিছু শুরু করলেও তাকেই অজুহাত বানিয়ে ডেকে আনা যাবে সব দেশকেÑ বিশেষ করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র তো বহুদিন ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়েই আছে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা ভেবেছিলেন, তেমন অবস্থায় একদিকে দেশের ভেতরে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সাজিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে ‘সাইজ’ করা যাবে, অন্যদিকে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে ডেকে আনা যাবে বিদেশি সেনাবাহিনীকে। বলা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের চাইতেও সরকারের বেশি আগ্রহ ছিল অন্য কোনো এক দেশের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে ঢোকানোর উপলক্ষ সৃষ্টি করার ব্যাপারে।
কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, কোনো রাজনৈতিক দলই সরকার এবং দেশ বিশেষের ভয়ংকর সে পরিকল্পনার ফাঁদে পা দেয়নি। এজন্যই দেবি থেমিসকে শাড়ি পরিয়েও কোনো লাভ হয়নি। ধাওয়ার মুখে থাকা জামায়াতে ইসলামীর প্রশ্ন ওঠে না, এমনকি ক্ষমকাসীনদের সঙ্গে কথিত নির্বাচনী সমঝোতার কারণে নিন্দিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মিদেরকেও মাঠে নামাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। কেউই কোনো ‘অ্যাকশনে’ যায়নি। জঙ্গি ও সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে ফেলার ষড়যন্ত্রও তাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। একই কারণে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরে যেতে হয়েছে বেচারী দেবি থেমিসকে। এ কাজটুকুও করা হয়েছে সেই চোরের মতোই। বিষয়টি নিয়ে নতুন পর্যায়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়েছে। দেবির মূর্তির মধ্যেও চেতনাওয়ালারা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা খুঁজতে শুরু করেছে- এমনভাবেই যেন যেখানে-সেখানে এবং যার-তার মূর্তি বানানোর অধিকার দেয়াও ছিল একাত্তরের একটি বড় অঙ্গিকার! এই উপলক্ষে আবারও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছে চেতনাওয়ালারা। তাদের কথা শুনে মনে হতে পারে যেন মূর্তি বানানোর অধিকারও ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্ভুক্ত একটি শর্ত এবং সে অধিকার অর্জনের লক্ষ্য নিয়েই বীর বাঙালি একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল!
এখানেই কিন্তু সবকিছু থেমে যাবে না। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরানো হলেও দেবি থেমিসকে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা বা ধ্বংস করা হয়নি। তাকে বরং সুপ্রিম কোর্টেরই অ্যানেক্স ভবনে ঠাঁই দেয়া হয়েছে- যথারীতি রাতের অন্ধকারে এবং চোরের মতো! বিষয়টি নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টাও যথেষ্ট জোরেশোরেই শুরু হয়েছে। সুতরাং ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ ধরনের ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে অনেক কিছুই দেখতে হতে পারে।
এবার ভারতের গরুবিষয়ক আলোচনা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক এক গরু বিষয়ক নির্দেশনাকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি রাজ্য। অনেক বড় বড় শহরে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে যখন-তখন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। ওদিকে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, তার সরকার কেন্দ্রের গরু বিষয়ক নির্দেশনা মানবে না। কেরালা এবং ত্রিপুরা রাজ্যের বামপন্থী সরকারও না মানার ঘোষণা দিয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের উচ্চ অদালতও গরু বিষয়ক নির্দেশনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। যেমন মোদী সরকারের এই নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে দায়ের করা এক মামলার রায়ে মাদ্রাজ হাই কোর্ট চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে তাদের বক্তব্য জানাতে হবে। ওদিকে অন্য এক জনস্বার্থ মামলার রায়ে কেরালার হাই কোর্টের বিচারপতিরা বলেছেন, সরকারের নির্দেশনার কোথাও বলা হয়নি যে, গরুর মাংস খাওয়া যাবে না। নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় বা অন্য কোনো স্থানে গরু জবাই করে খাওয়ার ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। গরু ও মহিষসহ গবাদি পশু জবাই করা ও খাওয়া যাবে নাÑ এমন কোনো কথাও নির্দেশনায় বলা হয়নি।
উল্লেখ্য, দিন কয়েক আগে দৃশ্যমান কোনো কারণ বা আশু কোনো উপলক্ষ না থাকা সত্ত্বেও মোদী সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় আকস্মিক এক নির্দেশনায় কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে গরু ও মহিষসহ গবাদি পশু কেনাবেচার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এক নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সীমান্তের ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো এলাকায় পশুর হাটও বসানো যাবে না। সীমান্ত বলতে শুধু বাংলাদেশ সীমান্তের কথা বলা হয়নি। আসাম, পশ্চিম বঙ্গ এবং ত্রিপুরাসহ ভারতের সকল রাজ্যের সীমান্তগুলোকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। কোনো সীমান্তেরই ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো এলাকায় পশুর হাট বসানো যাবে না। শুধু তাই নয়, গরু ও মহিষ নিয়ে চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কেউ কোনো গরু বা মহিষ নিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় তার সঙ্গে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ধরনের কর্তৃপক্ষের দেয়া এই মর্মে সার্টিফিকেট থাকতে হবে যে, ওই পশুকে জবাই বা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বিক্রি করার জন্য নেয়া হচ্ছে না। শুধু কৃষি কাজে ব্যবহার করা হবে মর্মে সার্টিফিকেট থাকলেই কোনো পশুকে নিয়ে যেতে দেয়া হবে। না হলে পশুর সঙ্গে যে ব্যক্তি নিয়ে যাচ্ছে তাকেও গ্রেফতার করা হবে এবং তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেয়া হবে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ থেকে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের রাজনীতিকদের পাশাপাশি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ায় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে ঘটে চলা সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমের রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদী সম্ভবত গরুকেন্দ্রিক বিতর্কেই প্রথমবারের মতো বড় ধরনের বিপদে পড়তে চলেছেন। এর কারণ, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিচারালয় পর্যন্ত ভারতের সর্বত্র গরু বিষয়ক বিতর্কে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গরু খাওয়ার কারণে সংঘাত হচ্ছে প্রতিদিন। বলা হচ্ছে, মূলত মুসলিম বিরোধী নীতি ও মনোভাবের কারণেই মোদী সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তার ভিত্তিতে নির্দেশনা জারি করেছে। ওদিকে সরকারের এ নির্দেশনার ফলে ভারতের মাংস ও চামড়া রফতানিসহ সামগ্রিকভাবে চামড়া শিল্পই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কেন্দ্রীয় সংগঠন এফআইসিসিআই জানিয়েছে, নির্দেশনা জারির কয়েকদিনের মধ্যেই ভারতের মাংস ও চামড়া রফতানির পরিমাণ অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটলে চামড়া শিল্পই শুধু ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, দেশের চাকরির বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে চামড়া, পশুর ওষুধ, বোতাম, রঙের ব্রাশ ও টুথপেস্টসহ অনেক শিল্পও- যেগুলোর মূল উপাদান হিসেবে পশুর হাড়ের ব্যবহার করা হয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গরু বিষয়ক নির্দেশনাটির মধ্যে ভারতীয় মুসলিমদের পাশাপাশি বাংলাদেশ বিরোধী উদ্দেশ্যও প্রাধান্যে রয়েছে। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় পশুর হাট বসানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে যাতে ভারতীয় পশু আসতে না পারে- সে ব্যবস্থাই করা হয়েছে। অন্যদিকে অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যবেক্ষকরা কিন্তু মনে করেন, কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই বাংলাদেশে পশুর রফতানি বন্ধ করতে পারবে না। কারণ, রফতানির আড়ালে হাজার হাজার গরু আসে চোরাচালানের অবৈধ পথে। এই কাজে জড়িত রয়েছে ভারতেরই কয়েক লাখ চোরাচালানী। মোদীর সরকার চোরাচালানীদের দৌরাত্ম্য প্রতিহত করতে পারবে না। ফলে চোরাচালান বরং অনেক বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকবে। পাশাপাশি রয়েছে খোদ ভারতের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দিকটি। সুতরাং ঘোষিত নির্দেশনা প্রত্যাহার করার মাধ্যেমেই সৃষ্ট পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। নাহলে একদিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও হানাহানি বাড়তে থাকবে, অন্যদিকে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বে ভারতের অর্থনীতি।
ঘটনাপ্রবাহে ভারতের রাজনীতিক থেকে বিচারপতিদের ভূমিকা এসেছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। কারণ, একদিকে পশ্চিম বঙ্গ ও কেরালার সরকারসহ বিভিন্ন রাজ্য এর বিরোধিতা করেছে, অন্যদিকে বিভিন্ন রাজ্যের হাই কোর্টের বিচারপতিরাও কৌতূহলোদ্দীপক রায় ও পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করে চলেছেন। কোনো কোনো রাজ্যের হাই কোর্ট তো গরুকে জাতীয় পশুর মর্যাদা দেয়ার জন্যও অভিমত প্রকাশ করেছেন! লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মূর্তি এবং গরুর মতো বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা বিশ্বকে একথাই জানাতে চাচ্ছেন যেন দেশ দুটিতে জনমত দূরে থাকুক, মানুষেরও কোনো মূল্য নেই! মূল্য আছে শুধু দেবি নামের মূর্তির এবং গরু জাতীয় পশুর!

http://www.dailysangram.com/post/286467-