৩ জুন ২০১৭, শনিবার, ১০:৩৮

গুম এক গুরুতর অভিযোগ

|| ড. আবদুল লতিফ মাসুম ||


গুম শব্দটি বাংলাদেশ সমাজে অপরিচিত নয়। গ্রামগঞ্জে গুম শব্দটির বাস্তব প্রয়োগ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। হিংসা-প্রতিহিংসা এবং মামলা-মোকদ্দমার একটি অনুসঙ্গ হিসেবে গুম বিষয়টি পরিচিত হয়ে আসছে। এটি ‘ভিলেজ পলিটিক্সের’ বিষয় বলে কথিত। এখন এই ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ জাতে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘ন্যাশনাল পলিটিক্সে’ এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক উন্নয়নের তত্ত্বে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’, ‘ন্যাশনাল পলিটিক্স’ দিয়ে প্রভাবিত হওয়ার কথা। এখন ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ‘ন্যাশনাল পলিটিক্সে’ রূপান্তরিত হয়েছে। এর তাৎপর্য এই যে, দেশে রাজনৈতিক উন্নয়নের পরিবর্তে রাজনৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। সম্ভবত অবক্ষয় শব্দটিও বর্তমান রাজনীতির ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বলা উচিত রাজনৈতিক দেওলিয়াত্ব। যে ব্যাপকতা এবং ভয়াবহতায় গুম আমাদের রাজনীতিকে কলুষিত করছে অতীতে আর কখনো এ রকম ঘটেনি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান এবং প্রতিবেদন প্রমাণ করছে যে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত গুমের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১৭০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ৬৩ জন ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। এদের মধ্যে রয়েছেন ২০১২ সালে গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ইলিয়াস আলী ও ২০১২ সালে গুম হয়ে যাওয়া আর একজন গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। সালাহউদ্দিনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইনি শুধু গুম হননি তাকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। সমাজচিন্তক ফরহাদ মাজহার এসব পরিসংখ্যান দিয়ে সীমান্তের সংশ্লিষ্টতাকে ‘নতুন ফেনোমেনা’ বলে উল্লেখ করেন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গুম হয়ে যাওয়া ২৭৪ লোকদের মধ্যে ৩৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। বাকি ১৫৯ জনের মধ্যে অনেককে মুক্তি দেয়া হয়েছে অথবা কোনো না কোনো মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাকি ৮০ জনের কোনো খোঁজ-খবরই নেই। উল্লিখিত প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ জন নাগরিক গুম হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এপ্রিল থেকে ৩ জুন ২০১৭ পর্যন্ত গুমের হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া সম্ভব নয়। তবে পত্র-পত্রিকায় এ সময়ে বেশ কয়েকটি গুম এবং বন্দুকযুদ্ধের খবর বেরিয়েছে। সর্বশেষ গুমের যে ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছে, তা বেশ উদ্বেগজনক এবং অভূতপূর্ব।
জাতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, গত ৩০ মে ২০১৭ মঙ্গলবার দুপুরে নাটোরের বড়াই গ্রাম উপজেলার আপ্রাণ উচ্চবিদ্যালয় থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্র মোবারক হোসেনকে তুলে নেয়া হয়েছে। যারা তুলে নেন তারা সাদা পোশাকে ছিলেন। ওই ব্যক্তিরা নিজেদের র‌্যাব-১৩ এর সদস্য বলে পরিচয় দেন। পরে র‌্যাপ-১৩ এর পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করা হলে একজন জানান, তাদের কোনো টিম নাটোরে যায়নি। তবে নাটোর র‌্যাব ক্যাম্পের সহকারী পুলিশ সুপার নিশ্চিত করেন, মোবারক হোসেনকে র‌্যাব-১৩ এর সদস্যরা নিয়ে গেছে। ঘটনার বিবরণে বলা হয় বেলা ১টার দিকে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে চারজন ব্যক্তি বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। তারা প্রথমেই মোবারক হোসেনের সাথে কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে মোবারকের মোবাইল ফোনটি নিয়ে নেন এবং তাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যান। প্রধান শিক্ষক সংবাদমাধ্যমকে জানান, যাওয়ার সময় ওই ব্যক্তিরা একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যান। বলেন, জঙ্গিসংশ্লিষ্ট বিষয় খতিয়ে দেখতে মোবারককে নেয়া হচ্ছে। পরে ওই ফোন নম্বরে সারা দিন ফোন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাদা পোশাকের লোকেরা তাকে উঠিয়ে নেন। তারা র‌্যাব-১৩ এর বলে দাবি করেন এবং পরিচয়পত্র দেখান। যাওয়ার সময় তাদের একজন মেজর হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, মোবারকের বিরুদ্ধে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। স্কুলছাত্র মোবারকের বাবা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার ছেলে অনেকটাই প্রতিবন্ধী। সে স্পষ্টভাবে কথাই বলতে পারে না। তার জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রশ্নই আসে না।’
এ সংবাদটি বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হাজারও সংবাদের একটি। প্রায়ই গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর আসে যে, সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে কাউকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু কথিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কখনো কখনো দেখা গেছে, কোনো ব্যক্তিকে এ ধরনের গুম করার দুই মাস পরে কোর্টে সোপর্দ করা হয়েছে। এমনও হয়েছে যে, পত্রিকায় বন্দুকযুদ্ধের গল্পে তার মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার এমনও হয়েছে যে, কোনো জায়গায় তার লাশ পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো সময় গ্রেফতার করতে পারে। যদিও সাদা আইন অনুযায়ী তা পারে না। তবে কালা আইন অনুযায়ী তারা সব সময়ই সব কিছু পারে। পূর্বোক্ত পরিসংখ্যান থেকে আমরা দেখেছি যে, এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে কখনো কখনো প্রেস ব্রিফিং দেয়া হলেও এসব ঘটনায় সুনির্দিষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। কয়েক মাস আগে তিনজন রাজনীতিকের তিন সন্তানকে প্রকাশ্য দিবালোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। তার মধ্যে একজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। অপর দু’জনের বিষয়ে রাষ্ট্র বা সরকার নীরব। তারা যদি অপরাধ করে থাকে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করে থাকে, তাহলে অবশ্যই রাষ্ট্রের অধিকার আছে তাদের গ্রেফতার করার। তাদের যখন বিচারে সম্মুখীন হয়েছে তখন তাদের সন্তানেরা বিচার এড়ানোর ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং মৌলিক মানবিক অধিকারের স্বার্থে এবং সরকারের স্বচ্ছতার স্বার্থে তাদের সম্পর্কে তথ্য দেয়া উচিত।
এত অসংখ্য গুমের বিষয়টি যদি পর্যালোচনা করি তাহলে গুমের পেছনে তিন কারণের কথা বলা যায়। প্রথমত, বাংলাদেশের সমাজের ব্যক্তিগত হিংসাবিদ্বেষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে ব্যক্তি অপহৃত হতে পারে। মামলায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মামলাবাজ মানসিকতাসম্পন্ন লোকেরা এসব করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কৌশলগত প্রয়োজনে সাদা পোশাকে গ্রেফতার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আইনের বিধান অনুযায়ী তাদের পরিচয় স্পষ্ট করতে হবে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম কোর্টে হাজির করতে হবে। তৃতীয়ত, কোনো অপরাধী চক্র ব্যক্তিবিশেষকে অর্থনৈতিক স্বার্থে গুম করতে পারে। আজকাল বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা অসংখ্য ঘটেছে। বিশেষত শিশুরা পণবন্দী হয়েছে। এ তিনটি ক্ষেত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুমের ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথা রাষ্ট্রের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টাকার জন্য গুম হয়ে যাওয়া লোকদের উদ্ধারও করছে। কিন্তু দৃশ্যত রাজনৈতিকভাবে যেসব ব্যক্তি গুম হয়েছেন তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বারবার অভিযোগ করছেনÑ রাজনৈতিক বিরোধিতা নির্মূল করার জন্য সরকার সরাসরি এসব হত্যা এবং গুম সংঘটিত করছে। তারা উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমা অপহৃত হন। আজো তার হদিস মেলেনি। ২০১২ সালে গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয়পর্যায়ের নেতা ইলিয়াস আলীর বিষয়ে সরকার কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিতে পারেনি। ২০১৫ সালে বিএনপি নেতা সালাইউদ্দিনকে যখন সীমান্তের ওপারে পাওয়া যায়, তখন সরকার সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
২৭ মে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত ‘গুম একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ’ শীর্ষক সেমিনারের বক্তারা গুমের বিষয়ে দু’টি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। প্রথম অভিযোগটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এটা গুরুতর এই কারণে যে, রাষ্ট্র আইনগতভাবে এবং নৈতিকভাবে নাগরিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য। খোদ সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যদি অভিযোগ উত্থাপিত হয় তাহলে বুঝতেই হবে যে, সে সরকার বা রাষ্ট্র নৈতিক মানদণ্ডে শাসন করার অধিকার রাখে না। সেমিনারের অভিমত এই যে, ভিন্নমত দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে রাখতে গুম-খুনের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। আরো অভিযোগ করা হয় যে, বর্তমান সরকার গুমকে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত করেছে। তাদের মতে, সরকারের দুঃশাসনে মানুষের জীবনে কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। অপর অভিযোগটি স্পর্শকাতর, গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকতর গুরুতর তা হলো ‘রাষ্ট্রের ভেতরে আর একটি পক্ষ’। স্পষ্টত তারা বৃহৎ প্রতিবেশীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। সেমিনারের বক্তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের নমুনা দিতে গিয়ে সুখরঞ্জনবালী এবং সালাইউদ্দিনের উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে অনেক গুজব আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এখানে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের শত্রু নিধনে দীর্ঘ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছেÑ এ রকম গুজব অনেক দিনের। আর রাষ্ট্রীয় গুপ্তচর বাহিনী বা ‘র’-এর অস্তিত্ব একটি আইনগত বাস্তব বিষয়। ভারতেও বাংলাদেশের স্বার্থ পর্যবেক্ষণের জন্য নিশ্চয় বাংলাদেশী গোয়েন্দা রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এটি অলিখিত সত্য। তবে বৃহৎ প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে ছোট ছোট সব প্রতিবেশীর একই অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি স্রেফ গুজবই, এমন আশা করে আমরা প্রস্তাব করব যে দুই দেশের সুসম্পর্ক, সম্প্রীতি এবং সমঝোতার স্বার্থে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া উচিত। জাতীয় নিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/225190