২৬ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১৭

বেপরোয়া হুন্ডিতে অর্থপাচার

বাংলাদেশের এক রোগী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে জানতে পারলেন তাঁর চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা লাগবে। ওই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাঠানোর জন্য ওই রোগীর স্বজনরা ছুটে গেল রাজধানীর নয়াপল্টনে এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে। গত সোমবার সকাল ১১টায় তারা নয়াপল্টনে গাজী ভবনের একটি ফ্লোরে ১০ লাখ টাকা দিল এক হুন্ডি ব্যবসায়ীকে। সঙ্গে ভারতীয় ১০০ রুপির একটি নোটের ছয় সংখ্যার নম্বরও দিল। দুই ঘণ্টা পর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সিটি সেন্টারের কাছ থেকে বাংলাদেশে দেওয়া ১০০ রুপির নোটটির নম্বর মিলিয়ে আট লাখ ভারতীয় রুপি বুঝে নিলেন চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া ব্যক্তিটি। নানা কারণে এভাবে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে ভারতে।

আবার মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ আসছে দেশে। বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বা অপ্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ আসায় দেশে রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) প্রবাহ কমে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর নয়াপল্টন, বঙ্গবাজার, শাঁখারীবাজার ও চকবাজারে কয়েক শ হুন্ডি ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাঁরা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভারতে টাকা পাঠাতে পারেন হুন্ডি করে। ওই সব স্থানে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায় কারা বিদেশে টাকা পাঠান।

বাংলাদেশ থেকে শুধু ভারতেই নয়, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে টাকা। সোনা চোরাচালানের অর্থ পরিশোধ, রাজস্ব ফাঁকি দিতে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকে খোলা এলসিতে প্রকৃত মূল্য কম দেখিয়ে পণ্য আনার পর পণ্যের প্রকৃত মূল্যের বাকি অর্থ পাঠানো, বিদেশে টাকা পাচারসহ নানা কারণে হুন্ডি করা হয়।

জানা যায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুই ঘণ্টার মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে হন্ডির টাকা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলেও অন্য কোনো রাজ্যে টাকা পাঠাতে সময় নেওয়া হয় ২৪ ঘণ্টা।

ভারতে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো অর্থ নেন না হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। বিনা মূল্যে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ একটি সেবা দেওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চোরাই পথে যে সোনা বাংলাদেশে আসে তার বড় অংশই ভারতে চলে যায়; আর চোরাচালানের মাধ্যমে পাঠানো ওই সোনার দাম পরিশোধ করা হয় হুন্ডির অর্থে। এ কারণে ভারতে বেশি হুন্ডি হয়। সে ক্ষেত্রে যারা হুন্ডি করতে চায় তারা হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে ভারতীয় মুদ্রার একটি নম্বর দেয়, ওই নম্বরটি থাকে ভারতে অবস্থানরত প্রাপকের কাছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট কুরিয়ার বা বাহক টাকা নিয়ে চলে যায় ওই প্রাপকের কাছে। ওই ব্যক্তির কাছে থাকা ভারতীয় রুপির নম্বর মিলিয়ে হুন্ডির টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট নম্বরের রুপিটি হুন্ডির বাহক নিজের কাছে নিয়ে নেন। এতে প্রমাণ থাকে যে বাহক টাকা বিলি করেছেন।

চোরাই সোনার দাম পরিশোধ ছাড়াও চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া অনেক বাংলাদেশিও অর্থ নিয়ে যায় হুন্ডি করে। এ ছাড়া বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ী ভারত থেকে জামা-কাপড়, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করেন, তাঁদের অনেকেই ওই সব পণ্যের প্রকৃত মূল্য কম দেখিয়ে এলসি খোলেন রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ওই আমদানিকারকরা পরে আমদানি পণ্যের প্রকৃত মূল্যের বাকি অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করেন। এ ধরনের হুন্ডি বেশি হয় বঙ্গবাজার ও চকবাজারে। বঙ্গবাজারের অনেক ব্যবসায়ী ভারত থেকে শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক আমদানি করে থাকেন। আর চকবাজারের ব্যবসায়ীরা আমদানি করেন প্রসাধনসামগ্রী।

বিদেশ থেকে যেভাবে হুন্ডি হচ্ছে : সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বিকাশের মাধ্যমে হুন্ডি হয়ে দেশে অর্থ আসছে। ওই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে না আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার।

সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়ার সৈয়দ আলী রোডে দিন-রাত খোলা থেকে মোস্তফা সেন্টার। সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের ভিড় লক্ষ করা যায়। মোস্তফা সেন্টারের উল্টো দিকে রয়েছে সারি সারি ছোট ইলেকট্রনিক পণ্যর দোকান। প্রত্যেক দোকানে একটি করে বিকাশের সাইনবোর্ড রয়েছে। সাইনবোর্ডে বাংলায় বড় করে লেখা ‘এখানে বাংলাদেশে বিকাশ করা হয়’। বিকাশে অর্থ পাঠানো যায় যেসব মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সেগুলোর নেটওয়ার্ক সিঙ্গাপুরে না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে কাজটি করা হয় জানতে চাইলে ‘বিকাশ’ সেবাদানকারী এক দোকানের বাংলাদেশি কর্মচারী মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখান থেকে টাকাটা নিই। এরপর বাংলাদেশে আমাদের বিকাশ এজেন্ট রয়েছে তারা বিকাশটি করে দেয়। যখন এখানে কেউ বাংলাদেশে বিকাশ করতে আসে, আমরা তখন ভাইবারে তাদের বিকাশ নম্বর ও টাকার পরিমাণ জানিয়ে দেই। সঙ্গে সঙ্গে সেটি নির্দিষ্ট নম্বরে বিকাশ হয়ে যায়। মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতাঙ, চায়না টাউনসহ বেশ কিছু এলাকায়ও দেখা গেছে বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশে অর্থ পাঠানোর সাইনবোর্ড।

ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় কমেছে : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে নন-ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে প্রবাসী আয় ১৬.৬০ শতাংশ বেশি এসেছে। অর্থাৎ, গত তিন বছরে ১৬.৬০ শতাংশ প্রবাসী আয় কমেছে প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে। ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে মোবাইল ব্যাংকিং বা বিকাশ, আত্মীয়স্বজন ও হন্ডির মাধ্যমে এ অর্থ বাংলাদেশে আসছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে হুন্ডির মাধ্যমে এসেছে মোট প্রবাসী আয়ের ১০.০৪ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে হুন্ডির মাধ্যমে এসেছে ১২.৩১ শতাংশ।

তবে কি পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে বাইরে যাচ্ছে এর প্রকৃত কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/05/26/501552