২৬ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৪

বিচারপতি অপসারণ প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালতের শঙ্কা

অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার বিরোধিতা অ্যামিকাস কিউরির

ষোড়শ সংশোধনী অনুযায়ী বিচারক অপসারণের প্রশ্ন উঠলে সংসদে যদি কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে তখন সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের সবচেয়ে পবিত্র আইন তথা সংবিধান সংরণ করি। দেখা গেল সেখানে এমন কিছু সন্নিবেশিত হলো, যাতে শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তখন কী হবে? তখন জুডিশিয়ারি কী করবে?

‘পার্লামেন্টে টু থার্ড মেজরিটি (দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা) না থাকলে ওই পরিস্থিতিতে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলে তখন কী হবে? আমাকে এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে।

বিচারপতি অপসারণের মতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে গতকাল সপ্তম দিনের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে গতকাল জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান, ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ তাদের মতামত উপস্থাপন করেন।

শুনানিতে তিন অ্যামিকাস কিউরি বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার বিরোধিতা করে বলেছেন, প্রশাসনসহ অন্য সব ক্ষেত্রে অপসারণ ক্ষমতা নিজ দফতরের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন? তারা বলেন, যেসব দেশে বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত আছে, সেখানে এ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে।

অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত উপস্থাপন শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী রোববার দিন ধার্য করেন। রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারী পরে বক্তব্য উপস্থাপনের পর গতকাল আপিল বিভাগে এই মামলার সপ্তম দিনের শুনানিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য শোনেন। সংবিধান প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলায় সর্বোচ্চ আদালত ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন।

তিন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য
অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান সংবিধানের ওই সংশোধন যে সংসদে পাস হয়েছে, তার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।

অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পে অবস্থান জানিয়ে বলেন, প্রশাসনসহ অন্য সব েেত্র অপসারণের মতা নিজ নিজ দফতরের থাকলে বিচার বিভাগের েেত্র ব্যতিক্রম হবে কেন? তিনি বিচারপতিদের অপসারণের মতা সংসদের হাতে নেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বিভিন্ন দেশে আইনসভার হাতে বিচারক অপসারণের মতা থাকার যে নজির রাষ্ট্রপ তুলে ধরেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় অ্যামিকাস কিউরিয়া ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বলেন, ওই সব দেশেও এখন এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বক্তব্য উপস্থাপন শুরুর পর আরেক অ্যামিকাস কিউরি প্রবীণ আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান তার শারীরিক সমস্যার কারণে আগে বক্তব্য দিতে চাইলে তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়। বিচারপতি টি এইচ খানের পর রোকনউদ্দিন মাহমুদ তার বক্তব্য শেষ করেন।

রোকনউদ্দিন বিচারপতিদের নিয়ে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের করা বিভিন্ন মন্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, তাদের হাতে বিচারকদের অপসারণের মতা দেয়া যুক্তিযুক্ত নয়।

তিনি বলেন, ‘তোরে জজ বানাইছে কেডা’-পত্রিকায় এ রকম দেখেছি। যারা সংসদে দাঁড়িয়ে এ রকম কথা বলেন তাদের হাতে এটা (বিচারকদের অপসারণের মতা) ছেড়ে দিবেন? তখন জুডিশিয়ারির স্বাধীনতা থাকবে?

‘সুপ্রিম কোর্টের জজ নিয়ে সংসদে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সদস্যরা আলোচনা করেছেন। কিন্তু স্পিকার টু শব্দ করেননি।’

প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তিদের অপসারণের প্রক্রিয়া তুলে ধরে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন বলেন, ‘সিভিল সার্ভিসের ব্যক্তিদের কারা অপসারণ করেন? পুলিশকে কারা করেন? সেক্রেটারিদের কারা করেন? আপনি? সংসদ?’

‘কেউ না। তাদের উপরস্থরা রিমুভ করেন। অর্থাৎ সহকারী সচিবদের তদন্ত করেন যুগ্ম সচিবরা। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপ। মিলিটারিদেরটা তাদের ডিসিপ্লিনারিতে আছে। তাহলে আপনাদেরটা কেন পার্লামেন্টে যাবে?’ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে অরাজকতা তৈরির আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

‘এটা (ষোড়শ সংশোধনী) যদি হয়ে যায় তাহলে হাইকোর্টের জজদের তো আপনি (প্রধান বিচারপতি) কিছু বলতে পারবেন না। ওনারা যদি ১১টায় আসে, তখনো কিছুই বলতে পারবেন না। আবার খাস কামরায় কোনো ব্যক্তির সাথে যখন কথা বলবেন, তখন সংসদ কী দেখবে? তাকে (সংসদ) কে জানাবে?’

‘সংবিধান সংশোধনকারী সংসদটিই অবৈধ’
ষোড়শ সংশোধনী যে সংসদে পাস হয়েছে সে সংসদ যে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে সেই নির্বাচনকেই ‘অবৈধ’ বলে বক্তব্য দিয়েছেন প্রবীণ আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান।

ষোড়শ সংশোধনের আগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা নিয়ে আলোচনার পে মত দিয়েছেন তিনি। ত্রয়োদশ সংশোধনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, যা বিলোপ ঘটে পঞ্চদশ সংশোধনীতে।

ষোড়শ সংশোধনীর অন্তর্নিহিত কিছু বিষয় আছে উল্লেখ তার পরিণতি কী হতে পারে, ভবিষ্যতে কী হতে পারে, বর্তমানে কী হতে পারে তার একটি ব্যাখ্যাও দেন অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি।

একটি বিশ্লেষণে তিনি বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী যেটাকে বলা হচ্ছে এবং এটি পাস করেছে যে সংসদ, সেই সংসদ যেভাবে নির্বাচিত হয়েছে, সে নির্বাচনটাই বৈধ না।’

টি এইচ খান বলেছেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়টি সেটল না করে ষোড়শ সংশোধনীর আলোচনা ঠিক না। এটাকে প্রাসঙ্গিকভাবে দেখতে হবে।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করার েেত্র আদালতের রায়ের যে যুক্তি আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায়ে অবসরের পরে স্বার করা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

‘ত্রয়োদশ সংশোধনী আসলেই আদালত বাতিল করেছিল? আর যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী থেকে থাকে, এখনো বহাল থাকে তাহলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর যে রায় দিয়েছেন ১৬ মাস পরে, তখন তার (সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) শপথ ছিল না।’

অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস আগে তিনি যখন শর্ট অর্ডার দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম ও একাদশ নির্বাচন হওয়া উচিত বলে বলেছিলেন। সেটি মূল রায়ে ছিল না। ওই রায়ের কোনো বৈধতা নেই। কারণ ওই রায়টা যখন দিয়েছেন, তখন তিনি বিচারক ছিলেন না। বিচারক হিসেবে তিনি রায় দেননি। ওই রায়ে যে দু’জন বিচারপতি স্বার করেছেন তারাও কাজটি ঠিক করেননি বলে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি এইচ খান।

‘বাকি চারজন যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতি আলাদা রায় দিয়েছেন এবং বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি ইমান আলী আলাদা রায় দিয়েছেন। উনারা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ আইন বলে উনাদের রায়ে উল্লেখ করেছেন। তাহলে প্রশ্ন, ত্রয়োদশ সংশোধনী কে বাতিল করল?’

৯৬ বছর বয়সী টি এইচ খান পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘মজার বিষয় হলো পঞ্চদশ সংশোধনী যে দিন পাস হয়েছে, তার পরে কিন্তু রায় প্রকাশ হয়েছে। রায় প্রকাশের আগেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস করেছে। অথচ সরকার বলেছে, এটি আদালত বাতিল করেছে, আমরা করিনি।’

টি এইচ খান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরো শক্তিশালী করে সেখানে একটা ‘নমিনাল বডি’ না করে একটা ‘ফাংশনাল বডি’ করে মতা আরো বাড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করেন।

‘পার্লামেন্টারি রিমুভাল কার্যকর হচ্ছে না’
সংসদের হাতে বিভিন্ন দেশে বিচারক অপসারণের মতা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না বলে দাবি করেন ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম। ষষ্ঠ দিনের শুনানিতে বক্তব্য শুরু করে সপ্তম দিনে অসমাপ্ত বক্তব্য শেষ করেন তিনি।

ব্যারিস্টার আমীর সাংবাদিকদের বলেন, সারা দুনিয়াজুড়ে আমরা যে অবস্থা দেখছি, তাতে বিচারকদের অসদাচরণের কোনো ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে সেটি জুডিশিয়ারি ঠিক করবে। সেটিই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

‘পার্লামেন্টারি রিমুভাল কোনো দেশেই কার্যকর হতে পারছে না। ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াতেও সেখানে আরো বেশি বিতর্কের সৃষ্টি হয় এ নিয়ে। বেশির ভাগ দেশই সংসদ থেকে ফিরে এসেছে। তারা জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপরই দায়িত্ব দিয়েছে। যদি কোনো জজ ভুল করেন তার বিচার জুডিশিয়ারিই করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223114