২৬ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩৯

বিশুদ্ধ পানির সংকটে রাজধানীতে হাহাকার

রাজধানীতে তীব্র হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে কোন কোন এলাকায় বেড়েই চলছে পানির সংকট। এমনকি দিনের পর দিনও পানির সংকট সমাধান হচ্ছে না অনেক এলাকায়। এতে করে চরম দুর্ভোগ পড়েছে রাজধানীবাসী।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, পানি সংকটে রান্না ও বাসাবাড়ির কাজ করতে পারছেন না তারা। এছাড়া খাবার পানির সংকটে পড়েছেন প্রায় এলাকার মানুষ। বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি আনতে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নারীদের। টাংকিতে যেমন পানি নেই একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে সাপ্লাই লাইনগুলোও শুকিয়ে আছে।

ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন , 'গরমে চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা বাড়লেও আমাদের পানি সংকট নেই। রাজধানীর পানির ৭৮ ভাগই টিউবওয়েলে উত্তোলন করা হয়। বৃষ্টি না হওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। তাই টিউবওয়েলে পানি উত্তোলন করা যাচ্ছে কম। বৃষ্টি হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

ঢাকা ওয়াসা বলছে, ২৩০ কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে ২৪৫ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও সরবরাহ লাইনে ত্রুটি আর ভূগর্ভে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াই সংকটের কারণ। ঢাকায় দৈনিক পানির চাহিদা ২৩০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসার উৎপাদন সক্ষমতা ২৪৫ কোটি লিটার।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংকট নিরসনে সংস্কার করা হবে পানির সব লাইন। আর দীর্ঘমেয়াদে পানির টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হাতে নেয়া হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি বৃহৎ প্রকল্প। এগুলো হচ্ছে যশলদিয়া, গন্ধর্বপুর ও সায়েদাবাদ তৃতীয় ধাপ পানি শোধনাগার প্রকল্প। তবে এসব প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের একটি পানির পাম্প। প্রায় তিন মাস ধরে পানি পাচ্ছেন না এ এলাকার বাসিন্দারা। পুরো এলাকাতেই পানির তীব্র সংকট। সেখানকার ‘সবুজ-বাংলা আবাসিক’ এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ২০-২৫ দিন ধরে একটুও পানি পাচ্ছেন না তারা।

সংশ্লিষ্ট নলকূপের পানির প্রবাহ অর্ধেকের চেয়েও বেশি কমে যাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে ওয়াসার কর্মীরা জানালেও এর সমাধানে কোনো উদ্যোগের খবর দিতে পারেননি তারা।

ঐ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম খানম বলেন, এর আগে পানির জন্য এত ‘সাফারার’ হইনি। এবারই এত কষ্ট হচ্ছে। নতুন লাইন দেওয়ার পর থেকেই আমরা পানি পাই না। মাস খানেক ধরে দেখা যেত দুদিনে একবার পানি দিচ্ছে, কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে একেবারেই পানি আসছে না।

পাম্পের অপারেটর নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এখানে প্রথম কূপ যখন ছিল, সেটির পানি ১০ বছর ধরে সঠিকভাবে পেয়েছি। কিন্ত দ্বিতীয় কুপ বসানোর পরই সমস্যা দেখা দেয়। তিনবছর আগে বসানো এই কূপে প্রথমে প্রতি মিনিটে ৩২০০ লিটার পানি আসত। কিন্ত এখন প্রতি মিনিটে আসছে ১০০০ লিটার পানি।

তিনি বলেন, “ছয় মাস ধরে পাম্পের প্রোডাকশন (পানি উত্তোলন) কমছে, আর সমস্যা বাড়ছে। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, কিন্ত এখন আর পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই নতুন কূপ খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীর মুগদায় ওয়াসার এই পানির পাম্পে মানুষের সার্বক্ষণিক ভিড়ই যেন নগরীর পানি সংকটের প্রতীকী রূপ। বাসায় নেই পানি, তাই ওয়াসার পাম্পে ছুটতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

সূত্র জানায়, রাজধানীর মগবাজার, মধুবাগ, নয়াটোলা, চেয়ারম্যান গলি, মীরবাগ, খিলগাঁও, বনশ্রী, সেগুনবাগিচা,যাত্রবাড়ি এলাকার মিরহারিবাগ,ধেলাইপাড়সহ আশ্বে পাশ্বে এলাকায় পানির সংকট তীব্র। এছাড়া উল্টরার আশকোনা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কয়েক মাস ধরেই চলছে পানির সংকট। আর গ্রীষ্মকাল আসার পর নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়াসহ আরো কয়েকটি এলাকায়।

অধিকাংশ এলাকায় পানির দেখা মিলছে দিনে মাত্র দু-একবার। আবার দুর্গন্ধময় ও ময়লাযুক্ত হওয়ায় সেই পানিও ব্যবহারের অনুপযোগী। নগরবাসীর অভিযোগ, কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানো হলেও মিলছে না সমাধান। রাজধানীর জিগাতলার ঋষিপাড়ায় ১৫দিন ধরে পানি সংকটে প্রায় ৪শ' পরিবার।

একইভাবে জিগাতলা সরকারি ৬তলা কোয়ার্টারেও বেশ কয়েকদিন ধরে পানির সংকট রয়েছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।

রাজধানীর বনশ্রী আবাসিক এলাকায় কয়েক মাস ধরে ওয়াসার পাইপলাইনে কাজ চলছে। ওই কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই মাঝেমধ্যে পানিসংকট দেখা দিচ্ছে। তবে দুই দিন ধরে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। কোথাও ৭২ ঘণ্টায়ও পানি না আসার খবর পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগীরা জানায়, ওই আবাসিক এলাকায় আনুমানিক আড়াই লাখ লোকের বাস। পানি না পেয়ে কয়েক দিন ধরে তারা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। ওয়াসা অফিসে ঘুরে বাড়তি টাকা দিয়েও পানির গাড়ি পাচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ। তীব্র গরমের মধ্যে পানিসংকট তাদের ভোগান্তি আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ওয়াসা বলছে, এই মুহূর্তে তাদের পক্ষ থেকে তেমন কিছু করার নেই।

স্থানীয় বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই আমরা পানির তীব্র সংকটে আছি। কিন্তু গত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এক ফোঁটা পানিও পাচ্ছি না। ওয়াসা অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা পানি দিতে পারবে না বলে জানায়। তীব্র গরমের মধ্যেও দুই দিন ধরে গোসল করতে পারছি না।

ভুক্তভোগীরা জানায়, কখনো কখনো ওয়াসা থেকে তাদের বলা হয়, গভীর রাতে পানি আসতে পারে। এ অবস্থায় রাত জেগে পানির আশায় বসে থাকলেও পানির দেখা আর মেলে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে ওই এলাকায় ওয়াসার পাইপলাইনে কাজ চলছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়াসার পক্ষে এ কাজ করছে।

ঢাকা ওয়াসার (মডস জোন-৬) নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী উন্নয়নকাজ চলাকালীন যে সংস্থা কাজ করবে তারা পানির স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করবে। কিন্তু বনশ্রীর ক্ষেত্রে সেটা কেন হচ্ছে না বুঝতে পারছি না। ’ পানি সংকটের কারণে প্রতিদিন শত শত মানুষ ফোন করে পানির গাড়ি দিতে অনুরোধ করেছে বলে তিনি স্বীকার করেন। তবে পর্যাপ্ত গাড়ি না থাকায় পানি দিতে পারছেন না বলে জানান।

গরম বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, দক্ষিণ মনিপুর, কাফরুল এবং কল্যাণপুরেও পানি সমস্যা বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে এসব এলাকার বাসিন্দারা। কোথাও পানি নেই, আবার কোথাও বা পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। মিরপুর-২ নাম্বার সেকশন সংলগ্ন কাজীপাড়ায় তিন মাস ধরে পানি সংকট চলছে। মিরপুর-১৪ নাম্বার সংলগ্ন বৌবাজার এলাকায় পানির কল খুললে ময়লার সঙ্গে কেঁচোও আসে। আবার মাঝেমধ্যে পানি আসে না।

ইস্কাটন গার্ডেন, গোপীবাগ, পেয়াদাপাড়া, মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নাম্বার সড়ক, নবোদয় হাউজিং, উত্তরা ও গুলশানের কিছু অংশে পানি সমস্যার কথা জানিয়েছে এলাকাবাসী। পেয়াদাপাড়া, ওয়ারী ও বনগ্রম এলাকায় ওয়াসার পানিতে ঝাঁজালো গ্যাসের দুর্গন্ধ আসে। ওই পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুলে কিংবা গোসল করলে চোখ জ্বালা-পোড়া করে। গা থেকে দুর্গন্ধ আসে।

ওয়াসার দাবি, পানি সরবরাহ ঠিক আছে। কিন্তু ফার্মগেট, আদাবর, মিরপুর-২, মোহাম্মদপুর এবং কল্যাণপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পানি সংকটে বাসিন্দাদের নাকাল হতে দেখা গেছে।

তারা টাকা দিয়েও ওয়াসার এক গাড়ি পানি সংগ্রহ করতে পারছে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা ঢাকা ওয়াসার কাছে একাধিকবার অভিযোগ করার পরও সংকট নিরসনে উদ্যোগী হচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

সূত্র জানায়, বছরের পর বছর ধরে পানি তোলায় নেমে যাচ্ছে ঢাকার পানির স্তর। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় ৪০০ ফুট নিচ থেকেও পানি উঠছে না কোনো কোনো এলাকায়। আবার পানি পাওয়া গেলেও পরিমাণে কম। গভীর নলকূপে চাপ পড়ায় কোনো কোনোটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যখন-তখন। আর তাই সরবরাহ লাইনে পানির সংকট দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন।

১০ বছর আগে পুরান ঢাকায় গ্রীষ্মকালে পানি সংকট থাকলেও এখন ঢাকার প্রায় সব এলাকায়ই আছে এই সমস্যা। লাইনে চাপ কম থাকায় বিশেষ করে লাইনের শেষদিকের বাসাগুলো পানি পায় না এতটুকু। গত দুই মাস ধরে ওয়াসার কাছ থেকে গাড়িভর্তি পানি কিনে চাহিদা মেটাচ্ছে কোনো কোনো বাড়িওয়ালা।

মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ১ নাম্বার সড়কের স্বর্ণকুঞ্জ হাউজিংয়ে পানির সমস্যা চলছে গত দুই মাস ধরে। লাইনে পানি আসে না, কোনো কোনো দিন এলেও তা পরিমাণে খুবই কম। বাকি দিন পানির গাড়ি কিনে আনতে হয়। এই গরমে গোসল, কাপড় কাচা, রান্নাবান্নাথ কোনোকিছুই নিশ্চিত নয়। ত্যক্ত-বিরক্ত স্বর্ণকুঞ্জবাসী জানে না, এর প্রতিকার কী।

রাজধানী এবং নারায়ণগঞ্জে পানি তোলার জন্য গভীর নলকূপ আছে ৬৭০টি। বছরের পর বছর ধরে এসব নলকূপ দিয়ে পানি তোলা হলেও মাটির নিচের পানির স্তর পূরণ হয় খুবই কম। কারণ, নগরীতে জলাশয় কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। আর নিচু এলাকা ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসন। কংক্রিটের কারণে পানি চুইয়ে নিচে যেতে পারে না।

বিএডিসির সর্বশেষ গবেষণা বলছে, ঢাকায় পানির স্তর এখন গড়ে ২১০ ফুট নিচে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০ ফুট নিচে। প্রতি বছর এই স্তর নামছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ১০ বছরের মধ্যে ঢাকায় সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে পড়তে পারে। তাই সংস্থাটি সরকারকে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধ করার সুপারিশ করেছে। এই গবেষণাটি বেশ কয়েক বছর আগে করা। এখন পানির স্তর নেমে গেছে অনেক বেশি। কোথাও কোথাও ওয়াসার গভীর নলকূপে আগের মতো পানি ওঠে না।

পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন,আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে ভূগর্ভস্থ পানির বদলে মাটির ওপরের পানি ব্যবহারের কথা বলে আসছি। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তারা পরিকল্পনা নেয় ঠিকই, কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয় না।

http://www.dailysangram.com/post/285389