২৬ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৯

মুসলিম সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য

শাহ্ আব্দুল হান্নান

সংস্কৃতি কী এবং কী নয়, এ সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে ১০০ বছরের। এ বিতর্ক বেড়ে যায় মার্কসিজমের উত্থানের পর। মার্কসিজমের উত্থানের পর একটি নতুন দর্শন আসে Art for life’s sake নামে। তখন এ নিয়ে একটি বিতর্ক দেখা দেয় যে, Art for Art’s sake না Art for life’s sake? এ বিতর্ক আগে ছিল না। কমিউনিস্টরা এ বিতর্ক তুলে ধরেন। এটি করতে গিয়ে তারা বাড়াবাড়িও করেছেন। আর্ট এখানে সংস্কৃতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সংস্কৃতির ভেতর যে একটি সৌন্দর্য থাকতে হবে, তা তারা হাইলাইট করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। তারা এটিকে পুরোপুরি উপো করেছেন।

অন্য দিকে, যারা ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’-এর প,ে তারাও এ ইস্যুকে রাজনীতিকায়ন করেছেন। তারা বলেন, আর্ট আর্টের জন্য। অর্থাৎ এর মধ্যে সৌন্দর্য থাকতে হবে; সৌন্দর্যের চেতনা থাকতে হবে, যা কিছুই সুন্দর করে এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করে জীবনের বিভিন্ন দিক, সাহিত্য ও শিল্পকলায়, তা-ই সংস্কৃতি।

সংস্কৃতির প্রশ্নে যদি আমরা সুবিচার করতে চাই তাহলে সেখানে আর্ট বা সংস্কৃতিতে দুটো দিকই থাকতে হবে। জীবনের জন্য তা প্রয়োজনীয় হতে হবে। জীবনের জন্যই হবে, জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। এর মাধ্যমে জীবনকেই ধারণ করতে হবে। এটিই সত্য কথা। অন্য দিকে এটিও সত্য, যা কিছু সুন্দর নয় তা আর্ট বা সংস্কৃতি হবে না, তা জীবনের জন্য হলেও। কাজেই দু’টি উপাদানই প্রয়োজন; দু’টিই সত্য। এ বিতর্কের পরিসমাপ্তি প্রয়োজন। তবে আমার মনে হয় বর্তমানে এর পরিসমাপ্তি কিছুটা হয়েও গেছে। মার্কসিজমের পতনের পর এ বিতর্ক আর খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।

যেকোনো আদর্শভিত্তিক দলও এ কথা তুলতে পারে যে, আর্ট ফর লাইফস সেক। এ বিতর্ক ইসলামপন্থীদেরও দরকার নেই। ইসলামপন্থীদের সংস্কৃতির মধ্যে দু’টি বিষয়ের সমন্বয় ঘটাতে হবে।

সংস্কৃতির ডাইমেনশনের কথা বলতে গিয়ে এর বিভিন্ন ডাইমেনশনের কথা আসে। সঙ্গীত, সাহিত্য থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা সব কিছুই সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে। আরেক দিক থেকে বলতে গেলে বলা যায়, মানুষের জীবনাচারই সংস্কৃতি। মানুষের পুরো জীবনপদ্ধতিই সংস্কৃতি। সে হিসেবে, সংস্কৃতির অর্থ আরো ব্যাপক।

সংস্কৃতির সংজ্ঞার েেত্র আমাদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু মৌলিকভাবে আমরা স্বীকার করি, সংস্কৃতি একটি ব্যাপক বিষয়। সংস্কৃতি পুরো জীবনব্যবস্থার সাথেই সংশ্লিষ্ট। সংস্কৃতি প্রতিটি জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর যেমন অনেক দিক বা ডাইমেনশন রয়েছে, তেমনি সর্বোপরি, এটি জীবনকে সার্ভ করতে হবে। সৌন্দর্যকেও সার্ভ করতে হবে। আবারো বলি, এটিকে সুন্দরও হতে হবে এবং জীবনের জন্যও হতে হবে।

সংস্কৃতিকে কয়েকটি ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে হবে। সুস্থ বিশ্বাসের ওপর সংস্কৃতিকে দাঁড়াতে হবে। যদি দুর্নীতিগ্রস্ত চিন্তার (corrupt thought) ওপর সংস্কৃতি দাঁড়ায়, সে সংস্কৃতিও দুর্নীতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বিশ্বাস আচরণকে প্রভাবিত করে। সংস্কৃতি হচ্ছে আচরণ। তার পেছনে রয়েছে বিশ্বাস। এ বিশ্বাস দুর্নীতিগ্রস্ত হলে আচরণও সে রকমই হবে। বিশ্বাস সুস্থ হলে সেটিও সুস্থ হবে।

এখানে মুসলিম জাতির কথা বললে তার ভিত্তি অবশ্যই তাওহিদ হতে হবে। তাওহিদ বলতে আমরা বুঝি একজন স্রষ্টা রয়েছেন। সব সৃষ্টির একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা মানুষ; আল্লাহর প্রতিনিধি। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তার মিশনকে এ বিশ্ব, মহাকাশ সর্বত্র কার্যকর করা। এ জন্য মুসলিম সংস্কৃতিকে সব সময়ই শিরকমুক্ত হতে হবে। মুসলিম সংস্কৃতি এমন হতে হবে, যেন খলিফার মর্যাদা রা পায়। আল্লাহর যে প্রতিনিধি মানুষ, তার সাথে খাপ খায়। অর্থাৎ তা শালীন হতে হবে; সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে হবে; মার্জিত হতে হবে। অমার্জিত হলে চলবে না। এটি অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে অবশ্যই।

কাজেই সংস্কৃতির প্রথম ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। ইসলামের েেত্র এটি হচ্ছে তাওহিদ। তেমনি যদি আমরা ইসলামের বাইরে গিয়ে দেখি, তাহলে অমুসলিমদের মধ্যেও সুস্থ বিশ্বাস থাকতে হবে। সেটি তাওহিদ না-ও হতে পারে। সেটি আমার দৃষ্টিতে সঠিক না-ও হতে পারে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে যা-ই হোক না কেন, যদি স্রষ্টার ওপর বিশ্বাস থাকে, মানবতাবাদী হয়, তার ওপরেও যে সংস্কৃতি গড়ে উঠবে সেটিও ভালো হবে। মানবতার একটি অংশ মুসলিম। বাকি অংশ অমুসলিম। তাদের সংস্কৃতি ভালো হবে যদি তা সুস্থ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে হয়। তাদের েেত্র সেটি স্রষ্টার ওপর হতে হবে। যদি নাস্তিকতার ওপর হয়, তাহলে তি হবে। যদি স্রষ্টার অস্তিত্বের ওপর ভিত্তিশীল হয় তাহলে তা নাস্তিকতার চেয়ে অনেক ভালো হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেটি যদি মানবতাবাদী হয়, তাহলে অবশ্যই ভালো হবে। কিন্তু সেটি যদি জাতিপূজা বা গোত্রপূজা হয়, তাহলে সেটি হবে অসুস্থ সংস্কৃতি।

তাহলে আমরা বলতে পারি, সংস্কৃতির জন্য সুস্থ বিশ্বাস লাগবে। দ্বিতীয়ত, তা অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে। অবশ্য এটি প্রথমটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। যদি সংস্কৃতি সুস্থ বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠে, তাহলে তা অশ্লীলতামুক্ত হবেই। কারণ কোনো সুস্থ বিশ্বাসই বলে না, অশ্লীলতা ভালো। এ সংস্কৃতি অবশ্যই মানবজাতির জন্য হতে হবে। সংস্কৃতিকে মানবজাতির মহৎ উদ্দেশ্য পূরণ করতে হবে। মানবতাবাদী হতে হবে; কল্যাণধর্মী হতে হবে।

সংস্কৃতির আরেকটি ভিত্তি হচ্ছেÑ সৌন্দর্য চেতনা। এখানে সুন্দরের চেতনা থাকতে হবে। কোনো কিছুই অসুন্দর করা যাবে না। কাজেই সার্বিকভাবে বলা যায়, সংস্কৃতির ভিত্তির জন্য একটি সুস্থ বিশ্বাস থাকতে হবে। মানবতাবাদীও মানুষের প্রয়োজনে হতে হবে। অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে। কল্যাণধর্মী এবং সৌন্দর্য-চেতনামণ্ডিত ও সৌন্দর্য-বুদ্ধিমণ্ডিত হতে হবে।

এটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়। সংস্কৃতি নিয়ে সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। যেহেতু আমি একজন ইসলামপন্থী, এ কথা সে জন্য ইসলামপন্থীদের বেশি করে বলিÑ আমার অনেক কিছু পছন্দ হবে না; কিন্তু সেটিকে সরাতে হবে আস্তে আস্তে। ধৈর্য ধরে সরাতে হবে। যেটি রাখলে চলে, সেটি রাখতে হবে। কারণ ইসলামের শুরুতেই রাসূল সা: সরাসরি ইসলামবিরোধী নয় এমন স্থানীয় রীতিনীতি, আচার-আচরণকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরব আচার প্রথাকে মেনে নিয়েছিলেন। ইবনে তাইমিয়ার একটি বিখ্যাত ফতোয়া আছে, যেকোনো দেশের স্থানীয় কাস্টমস (রীতিপ্রথা) যদি সরাসরি ইসলামবিরোধী না হয়, একেবারে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ না হয়, তাহলে সেটি থাকবে। আমরা এ ব্যাপারে অনেক সময় কিছুটা হঠকারিতা করে বসি; কিছুটা বাড়াবাড়ি করে বসি। এগুলো থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। ইসলামের যে মহত্ত্ব, সামগ্রিকতা, ব্যাপকতা এবং বহু মত ও পথের সুযোগ আছে, সে বিষয়টি মনে রাখতে হবে।

সংস্কৃতির েেত্র আমাদের বিভিন্ন মতামতকে মানতে হবে। এখানে বিভিন্ন মত ও পথের স্বীকৃতি আমাদের দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী ইসলামের যে সংস্কৃতি, তার তো একেক দেশের একেক সংস্করণ। ইন্দোনেশিয়ার ইসলামি সংস্কৃতি রূপে রসে রঙে একই সাথে ইসলামিক হবে, ইন্দোনেশিয়ানও হবে এবং এই দুইয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। সংস্কৃতির ভেতর যদি সুস্পষ্টভাবে ইসলামবিরোধী কোনো মৌল উপাদান না থাকে তাহলে তা ইসলামি সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধা নেই। বাংলাদেশের েেত্রও একই কথা প্রযোজ্য। তেমনিভাবে তা প্রযোজ্য মরক্কো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের েেত্র। প্রত্যেকের নিজস্ব রঙ হবে। আমার মনে হয় এটি অনেকটা এ রকম হবে যে, একই বাগানে ১০০টি ফুলগাছ। এ বিষয়গুলো ইসলামি সংস্কৃতি কর্মীদের ভেবে দেখা দরকার। এ বিষয়টি বিচার করে দেখা দরকার।

পাশ্চাত্যের কালচার দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও বস্তুবাদের ওপর ভিত্তিশীল। বস্তুবাদ হলো, ভোগবাদ ও স্বার্থপরতা। এ কারণেই কালচার খুব নোংরা হয়ে গেছে। কালচার নিছক নারীকেন্দ্রিক শুধু নয়, নারীর অপব্যবহারকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার যে প্রবণতা, তা রুখতে হবে। এ জন্য পশ্চিমাদের মধ্যে যারা ভালো তাদেরও উৎসাহিত করতে হবে। পশ্চিমা বস্তুবাদ নাস্তিকতা না হলেও নাস্তিকতার কাছাকাছি। এর বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ বস্তুবাদ মানবতার জন্য কল্যাণকর নয়।

সংস্কৃতির বাইরে কোনো মানুষ থাকতে পারে না। সমাজ হতে পারে না। তাই মানুষের পে সংস্কৃতিবিমুখ হওয়াও সম্ভব নয়। কালচারের মূল দিক হচ্ছে জীবনাচার, পুরো জীবন। প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি উচ্চারণ, বক্তব্য, চলাচল, ভ্রমণ, কথন সব কিছু হচ্ছে তার কালচার। আমরা খুব গভীরভাবে না দেখার কারণে গান-নাচকেই বড় ভেবে এসব বিষয়কে ছোট ভাবি। কিন্তু এগুলো না থাকলেও একটি জাতির পে সংস্কৃতিবান হওয়া সম্ভব। এগুলো বাদ দিয়েও জাতি সংস্কৃতিবান হতে পারে। অনেক জাতিই আছে, যাদের গান খুব পপুলার নয়, যাদের নাচ নেই, তাতে কিছু আসে-যায় না।

আমরা বিনোদনের নামে যা খুশি তাই করতে পারি না। জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে, বিনোদন। এর প্রয়োজন আছে। আধুনিক বিশ্বে বিনোদনকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের দৈনিক জীবনের একটি বড় অংশ রাস্তায় চলে যায়। তার সাথে অফিসের সময়। প্রতিটি েেত্রই মানুষ ব্যস্ত। এ অবস্থায় তার জন্য অবশ্যই সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিনোদনকে সুস্থ হতে হবে; অসুস্থ হওয়া যাবে না। অশ্লীল হওয়া যাবে না। কুস্বভাব সৃষ্টি করে, অপরাধ ছড়ায়, এমন কিছু করা যাবে না। খারাপ যা খুব কম ঘটে, তাকে নাটকে এনে জাতিকে জানাতেই হবেÑ তা আসলে জরুরি নয়। সাহিত্যের নামে যেটি করা হয় তা হলো একটি পরিবারের দুর্ঘটনা পুরো জাতিকে জানানো হয়। কিন্তু তা যদি সুন্দর কিছু হতো, তাও কথা ছিল।

আসলে বিনোদনের মধ্যে একটি সীমা থাকতেই হবে। সে সীমা থাকতে হবে আইন ও প্রথার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে স্বাধীনতার নামে আমরা কদাচারকে অনুমোদন করতে পারি না। আমরা এমন স্বাধীনতা চাই না যে স্বাধীনতা মানুষকে অমানুষ বানায়।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223027