২৫ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:২০

স্মার্ট কার্ড নিয়ে বহুমুখী সমস্যা

স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্ট কার্ড) বিতরণে বহুমুখী সমস্যায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও বিতরণ শুরুর পর গত সাড়ে সাত মাসে মাত্র ১৮ লাখ নাগরিককে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মাত্র ২ শতাংশ কার্ড বণ্টন হয়েছে। এখন বাকি সাত মাসে ৮ কোটি ৮২ লাখের বেশি নাগরিককে কার্ড দিতে হবে। এই প্রকল্পের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্য কাজ শেষ করা প্রায় অসম্ভব।
এরই মধ্যে ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও প্রায় সোয়া কোটি নতুন ভোটার। এই ভোটাররা কবে নাগাদ স্মার্ট কার্ড পাবেন, সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল কেউই কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
২০০৭ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির সময় অতিরিক্ত (বাই প্রডাক্ট) হিসেবে কাগজে ছাপানো একটি পরিচয়পত্র দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু এই পরিচয়পত্রটি মেশিন রিডেবল নয়। স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্লাস্টিক কার্ডে তৈরি। মেশিন রিডাবল। এর সঙ্গে একটি চিপ আছে। এই কার্ডধারিদের দুটি অতিরিক্ত তথ্য সরকারের ডাটাবেইজে আছে। বিভিন্ন নাগরিক সেবার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এই কার্ড ব্যবহার হবে বলে জানানো হয়েছে।
কার্ড বিতরণের সঙ্গে যুক্ত নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের ৩ অক্টোবর থেকে ঢাকায় স্মার্ট কার্ড বিতরণ শুরুর সময় একবার নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে নাগরিকেরা কার্ড নিতে পারতেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে লম্বা লাইন, অনেকে গিয়েও কার্ড না পাওয়ার কারণে প্রথমেই বিতরণ নিয়ে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এরপর সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও মানুষের আগ্রহ কমতে থাকে। কার্ড বিতরণে লোকবল-সংকটের কারণে এখন একজন নাগরিককে দুই দিন কেন্দ্রে যেতে হচ্ছে। এক দিন আঙুলের ছাপ দিয়ে আরেক দিন কার্ড আনতে হচ্ছে। এখন হাতে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে কাজ চলে যাওয়ায় অনেকেই কেন্দ্রে যাচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরবরাহকারী ফরাসি প্রতিষ্ঠান থেকে যথেষ্ট ব্ল্যাঙ্ক (ফাঁকা) কার্ড না আসা, কার্ড ছাপানোর জন্য মেশিনের অপ্রতুলতা, কার্ড সংগ্রহের ক্ষেত্রে গ্রাহকের ভোগান্তি, প্রায় দেড় কোটি ভোটারের তথ্য ভুলসহ নানা কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে।
স্মার্ট কার্ড প্রস্তুত ও বিতরণের জন্য ফ্রান্সের অবার্থুর টেকনোলজিসের সঙ্গে ২০১৪ সালে ৮০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ইসি। তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল ৯ কোটি কার্ডের। দফায় দফায় পিছিয়ে সেই কার্ড বিতরণ শুরু হয় ২০১৬ সালে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের মেয়াদ দেড় বছর বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া এই কার্ড নাগরিকদের মধ্যে বিতরণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। সময়মতো কার্ড বিতরণ না হলে সেগুলো বিতরণের জন্য নতুন করে আরও অর্থ ব্যয় করতে হবে কমিশনকে।
ভোটার তালিকা তৈরি ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্মার্ট কার্ড দেওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাঁরা বলছেন, কার্ড নিতে ভোটারের ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ নেওয়া বাধ্যতামূলক না থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এটি দেওয়ার চেষ্টা করা যেত। কিন্তু এখন কার্ড বিতরণ ও প্রস্তুতকাজ যে পর্যায়ে আছে, তাতে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি শেষ করা প্রায় অসম্ভব।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। এই অনুবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তাদের তথ্যভান্ডারে ১০ কোটি ১৭ লাখেরও বেশি ভোটারের তথ্য আছে। এখন ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে যাঁরা ভোটার হয়েছেন, তাঁদের কার্ড দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারির পর ভোটার হয়েছেন, তাঁদের এখনই স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। তাঁরা আপাতত কাগজে লেখা লেমিনেটেড পরিচয়পত্র পাবেন।
ভোটার তালিকা তৈরি ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (ডিসেম্বর ২০১৭) সব ভোটারকে কার্ড দিতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একটি সূত্র জানায়, স্মার্ট কার্ড দেওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে সম্পূর্ণ গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে দেশেই স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বিগত কমিশনের নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ তাঁর মেয়াদ শেষ করার আগে নতুন কমিশনের জন্য একটি প্রস্তাবনা দেন। সেখানে ভোটার তালিকা তৈরি ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগকে একটি আলাদা বিভাগের মাধ্যমে পরিচালনার কথা বলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটি নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকা দরকার। কমিশনের কর্মকর্তারা এই কাজের সঙ্গে থাকলে নির্বাচনের কাজের সমস্যা হবে।
কার্ড নিতে কেন্দ্রে যেতে অনীহা
রাজধানীতে স্মার্ট কার্ড বিতরণ সাত মাস পেরিয়ে গেলেও নানা সমস্যয় এখনো দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় বিতরণের কাজ শেষ হয়নি। কমিশন সূত্র জানায়, তাদের হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী যেসব এলাকায় কার্ড বিতরণ চলছে, সেসব এলাকার প্রায় ২৮ লাখ নাগরিকের মধ্যে মাত্র ১৬ লাখের হাতে স্মার্ট কার্ড পৌঁছেছে। তারা বলছে, চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে ঢাকায় কার্ড বিতরণকাজ শেষ হবে।
ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, ঢাকার ৫২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৭ জন ভোটারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। তিনি বলেন, নানা কারণে এখনো ৪০ শতাংশ নাগরিক কেন্দ্রে উপস্থিতই হতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রায় ৬০ শতাংশ কার্ড বিতরণ হয়েছে। আর কেন্দ্রে গিয়েও কার্ড পাননি এমন লোকের সংখ্যা ১ লাখের বেশি। এই কর্মকর্তা বলেন, নির্ধারিত সময়ে যাঁরা স্মার্ট কার্ড নিতে পারেনি, তাঁরা থানা নির্বাচন অফিস থেকে তা সংগ্রহ করতে পারবেন।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক আবদুল বাতেন বলেন, ঢাকা ছাড়াও কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে প্রায় সোয়া লাখ কার্ড বিতরণ হয়েছে।
অর্ধেকের বেশি ভোটারের স্মার্ট কার্ড তৈরিই হয়নি
৯ কোটি ভোটারকে ডিসেম্বরের মধ্যে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি কার্ড তৈরিই হয়নি। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্স থেকে ৯ কোটি ব্ল্যাঙ্ক কার্ড আসার কথা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এসেছে প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ ব্ল্যাঙ্ক কার্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বাকি কার্ড দিতে বলা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তারা কার্ড দেবে বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তিনি বলেন, ফ্রান্সের ওই প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে কার্ড দিতে ব্যর্থ হলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্মার্ট কার্ড প্রকল্পের একটি সূত্র বলেছে, ব্ল্যাঙ্ক কার্ডে স্মার্ট কার্ড ছাপাতে তাদের মাত্র ১০টি প্রিন্টার রয়েছে। এ বছরের মধ্যেই সব নাগরিকের হাতে কার্ড পৌঁছাতে হলে আরও ১৮টি প্রিন্টার মেশিনের প্রয়োজন। এ অবস্থায় ১০টি মেশিনেই শিফট সংখ্যা বাড়িয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
স্মার্ট কার্ডের বিতরণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে নাগরিকদের ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশের প্রতিচ্ছবি না নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। কিন্তু সমালোচনা এড়াতে কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে।
এই প্রস্তাবের কারণ সম্পর্কে কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের কাছে স্মার্ট কার্ড পৌঁছাতে হবে। এখন সময় কম, বিতরণকাজ সহজ করতে হবে। এ জন্য আঙুলের ছাপ ও আইরিশের প্রতিচ্ছবি না নিয়েই দ্রুত স্মার্ট কার্ড নাগরিকদের হাতে পৌঁছাতে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1192341/