২৫ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:১৬

মতিঝিলে বহুতল ভবনের ফ্লোর কিনে বেকায়দায় বেসিক ব্যাংক

ঢাকার মতিঝিলে ১৫ তলা ভবনের ১২টি ফ্লোর কিনতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। চুক্তি মতে সময় পেরিয়ে গেলেও ফ্লোরগুলোর রেজিস্ট্রেশন ও দখল বুঝে পাচ্ছে না ব্যাংকটি। পাশাপাশি দাম বাবদ পরিশোধ করা ৭৬ কোটি টাকাও পড়ে গেছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।

মতিঝিলে নির্মাণাধীন ভবনের ১২টি ফ্লোর বিক্রির কথা বলে টাকাগুলো নিয়েছেন ওই জমির মালিক ও ভবন নির্মাতা সিঙ্কু আক্তারুজ্জামান; সংক্ষেপে তিনি নিজের নাম সিঙ্কু এ জামান বলে পরিচয় দেন। ২০১৩ সালের মার্চে ভবনের নির্মাণকাজ শেষে করে রেজিস্ট্রেশন ও দখল বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও ১৫ তলা ভবনটির নির্মাণ এখনো শেষ হয়নি। ব্যাংকের তরফ থেকে দ্রুত রেজিস্ট্রেশন ও দখল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার চিঠি দেওয়া হলেও সাড়া দিচ্ছেন না সিঙ্কু। উল্টো ১৫ তলার ওপর আরো সাততলা নির্মাণ করা হবে উল্লেখ করে বেসিক ব্যাংককে তা কিনতে চাপ দিচ্ছেন তিনি। আর ওই সাততলার জন্য বাড়তি চাচ্ছেন ১৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮১ কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধের জন্য ব্যাংককে চাপ দিয়ে চলেছেন তিনি। আর কোনো উপায় না পেয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছে ব্যাংকটি।
গত ৮ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়ে পাঠানো চিঠিতে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার মো. ইকবাল বলেছেন, মতিঝিলে নির্মাণাধীন ১৫ তলা ‘জামান-বেসিক ব্যাংক টাওয়ার’-এর গ্রাউন্ড ফ্লোর, দ্বিতীয় তলা, তৃতীয় তলা থেকে ১২ তলা পর্যন্ত ৫১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের ফ্লোর এবং ১৪টি কার পার্কিংসহ মোট ১২ দশমিক ৫০ কাঠা জমির আনুপাতিক অংশসহ ৮০ কোটি টাকায় কেনার চুক্তি হয় ২০১০ সালে। চুক্তির দিন ৪০ কোটি টাকা
অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। পরে বিভিন্ন সময় কিস্তিতে আরো ৩৬ কোটি টাকা নিয়েছেন সিঙ্কু এ জামান। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা। পরে সিঙ্কু ২০১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিলেও এখনো ফ্লোরগুলো বেসিক ব্যাংকের নামে রেজিস্ট্রেশন করে দিচ্ছেন না। সিঙ্কু বিজনেস রিসোর্স লিমিটেড নামের একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানেরও মালিক বলে জানা গেছে।
২০১০ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বলা ছিল, ভবিষ্যতে ভবনটির অন্য কোনো ফ্লোর বিক্রি করতে চাইলে বেসিক ব্যাংককে প্রাধান্য দিতে হবে। আগের ১২ তলার রেজিস্ট্রেশন না করে দিয়ে ভবনের মালিক সিঙ্কু ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বেসিক ব্যাংককে জানান, ১৫ তলার ওপর আরো সাততলা নির্মাণের বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নিয়েছেন তিনি। ওই সাতটি তলাও বেসিক ব্যাংককে কিনতে হবে। আর সিঙ্কু ওই সাতটি ফ্লোরের দর হাঁকেন ১৬২ কোটি টাকা, যার অর্ধেক বা ৮১ কোটি টাকা অগ্রিম দাবি করেন। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও এমডি কয়েক দফা সিঙ্কুর সঙ্গে বৈঠক করেও আগে নেওয়া টাকার বিপরীতে ১২ তলা পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন ও দখল দিতে তাঁকে রাজি করাতে পারেননি। তাঁর এক কথা, আরো যে সাততলা নির্মাণ হবে, তা কিনতে হবে এবং তার ৫০ শতাংশ বা ৮১ কোটি টাকা অগ্রিম দিতে হবে।
ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা খতিয়ে দেখেছেন, খুবই নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো ১৫ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণে সিঙ্কুর মোট খরচ হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রায় শখানেক চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেসব চিঠির উত্তরে সিঙ্কু কেবল বাড়তি সাততলার দাম দাবি করেন। এ অবস্থায় বেসিক ব্যাংকের মালিক যেহেতু সরকার, তাই আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। ’
ভবন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ছোট্ট একটি গেটে তালা লাগানো। তালা নাড়িয়ে শব্দ করতেই একজন বৃদ্ধ এলেন। সিঙ্কু সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে যান। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে এলেন এক ব্যক্তি, নাম জানালেন দেলোয়ার। সিঙ্কুর সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ২৮ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আছি। তিনি বাংলাদেশে থাকেন না, বিদেশে থাকেন। ’ কোন দেশে থাকেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায়। ’ যোগাযোগের নম্বর চাওয়া হলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেলোয়ার বলেন, ‘স্যার আমাদের ফোনই ধরেন না, আর আপনার ফোন!
পরে বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সিঙ্কুর একটি মোবাইল ফোন নম্বর পাওয়া যায়, যেটিতে সর্বশেষ মাস তিনেক আগে ব্যাংকটির এমডি কল করে কথা বলেছিলেন। ওই নম্বরে কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে কয়েক দফা কল করলেও কেউ তা ধরেনি; এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই বিষয়টি নিয়ে সিঙ্কু এ জামানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, বেসিক ব্যাংকের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। বর্তমানে মতিঝিলে সেনাকল্যাণ সংস্থার কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে প্রধান কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্যাংকটি। কেনা ফ্লোরগুলোর দখল না পাওয়ায় একদিকে যেমন ৭৬ কোটি টাকা বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে; ভাড়া ফ্লোরগুলোর ভাড়া বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে; অন্যদিকে ৭৬ কোটি টাকা দিয়ে যে ১২টি ফ্লোর কেনা হয়েছে, দীর্ঘদিনেও তার রেজিস্ট্রেশন ও দখল হস্তান্তর না হওয়ায় ওই সম্পদকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যাসেল-২-এর আওতায় আরো ৭৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়ছে। যত দিন ভবনটির দখল-হস্তান্তর না পাবে বেসিক ব্যাংক, তত দিন পর্যন্ত ব্যাংকের ওই ৭৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকেই থাকবে। ফলে নানাভাবে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে বেসিক ব্যাংককে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/05/25/501194