২৪ মে ২০১৭, বুধবার, ৭:৫৮

থামানো যাচ্ছে না নদী দখল

দক্ষিণ-পশ্চিমে দখল হয়নি এমন কোন নদী নেই

কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদী দখল। সবখানে সমানতালে চলছে দখলের মহোৎসব। দখল প্রক্রিয়া থামানোর জন্য মাঝেমধ্যে সরকারী পদক্ষেপ নেয়া হয় ঠিকই। কিন্তু তার মেয়াদ খুবই কম। বাকি সময় চলে দখলের প্রতিযোগিতা। সাধারণ লোক নয়, দখলদারদের সবাই প্রভাবশালী। স্রোতহীন নদীতে খুব সহজেই পাটা ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, শুকিয়ে যাওয়া নদের পাড়ে মাটি ভরাট করে দখলে নিয়ে পৈত্রিক সম্পত্তির মতো গাছপালা লাগানো ও চাষাবাদসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা, এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ী-ঘর নির্মাণের দৃশ্য দেখা যাবে না এমন কোন নদী খুঁজে পাওয়া কঠিন। অনেক নদীর অনেকস্থানে অস্তিত্বও মুছে যাচ্ছে। একে তো শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে, তার উপর সামগ্রিক স্বার্থের কথা বিবেচনায় না নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে। এই চিত্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের। নদপাড়ে একটু দৃষ্টি দিলে খুব সহজেই পরিস্কার হওয়া যাবে কিভাবে কতটা দখল হয়েছে। অথচ কারোই যেন কোন মাথাব্যাথা নেই। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, যশোর ও খুলনার ভৈরব নদ, মুক্তেশ্বরী, কপোতাক্ষ, মাগুরা ও ঝিনাইদহের নবগঙ্গা, কালীগঞ্জের চিত্রা, নড়াইলের মধুমতি ও চিত্রা, শৈলকুপার কুমার, কুষ্টিয়ার গড়াই ও চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এমন কোন নদী নেই, যার কোথাও না কোথাও দখল হয়নি। নড়পাড়ের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এমনিতেই তো পদ্মার শাখা প্রশাখা নদ-নদীর অবস্থা শোচনীয়। যতটুকু শ্বাস-প্রশ্বাস আছে, তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দখলের কারণে।
নদীর বুকের পাথর সরানোর ন্যুনতম কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বছরের পর বছর। নদীর পানি প্রবাহ কমে পলি জমে ভরাট হওয়ার পাশাপাশি দখলের প্রতিযোগিতা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে, একযোগে দখলমুক্ত করে নদী বাঁচানোর কোন বিকল্প নেই বলে নদী বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক মহল থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। নদপাড়ের লোকজনের বক্তব্য, বারবার দখলমুক্ত করার চেষ্টা চলে, কিন্তু নদী দখল বন্ধ হয় না। বরং দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। যখন যেখানে যে যেমন পারছে নদপাড় এমনকি নদের বুকেও দখল নিচ্ছে। আসলেই কোথাও নদ-নদী তার আপন গতিতে চলতে পারছে না। নদীতে স্রোত না থাকায় কচুরীপনা ও ময়লা জমে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটছে। নদ-নদীর প্রাণশক্তি ক্রমাগতভাবে কমে যাওয়ায় পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে।
পানি উন্নযন বোর্ড, সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠান ও নদী নিয়ে কাজ করা বেসরকারী সংগঠন কারো দপ্তরেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীতে কতটুকু সরকারী জমি দখল হয়েছে, কতসংখ্যক পাটা ও বাঁধ আছে কিংবা কত মাইল দখল করে কোথায় কারা কিভাবে চাষাবাদ কিংবা বাড়ীঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন সুত্রের আনুমানিক হিসাবে পাটা ও বাঁধ আছে অন্তত ৫ হাজার। আর দখল হয়েছে লক্ষাধিক একর নদীর জমি। এই অঞ্চলের ৪ শতাধিক কিলোমিটার নদপথের প্রায় তিন শ’ কিলোমিটার শুকিয়ে গেছে। যশোরের ভৈরব ও কপোতাক্ষ নদ রক্ষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জানান, নদীতে পাটা ও বাঁধ দেয়া এবং দখলের কারণে কপোতাক্ষসহ নদ-নদীর অবস্থা করুণ। যশোর শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদটি মৃত্যুমুখে। ভৈরব নদটি গঙ্গা থেকে বের হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে সীমান্ত জেলা মেহেরপুরে ঢুকেছে। মেহেরপুরের সুবলপুর পয়েন্টে মিশেছে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে। ভৈরব আর মাথাভাঙ্গা অভিন্ন ধারায় দর্শনা রেলস্টেশন এলাকা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। কিন্তু ১৮৬১ সালে শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া রেলপথ স্থাপনের সময় ভৈরব নদ ভরাট করে মাথাভাঙ্গা নদীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ওই পয়েন্ট থেকে দর্শনা ও জীবননগর হয়ে ভৈরব নদ এসে মিশেছে চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষের সাথে। সেখান থেকে ভৈরব নদ যশোর ও শিল্পশহর নওয়াপাড়া হয়ে শিল্পনগরী খুলনা ছুঁয়ে সুন্দরবনের পশুরনদীতে গিয়ে মিশেছে। ভৈরব নদকে ঘিরেই মূলত যশোর, নওয়াপাড়া ও খুলনায় নগর, শহর ও শিল্প গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যও স¤প্রসারিত হয়। ভৈরব নদে একসময় বড় বড় জাহাজ ভিড়তো। এখন ভৈরবে নদীপথ নেই বললেই চলে।
এ অঞ্চলের মধ্যে মরা ভৈরব দখল সবচেয়ে বেশী। নদপাড়ের মানুষ বহুদিন থেকেই স্বপ্ন দেখে আসছে দখলমুক্তের। কিন্তু বাস্তবে সেই স্বপ্ন পুরণ হয় না কখনো। মাঝেমধ্যে অভিযানের কথা ঘোষিত হলে মানুষ স্বপ্ন দেখেন এবার হয়তো নদের আসল চেহারা দেখা যাবে। কিন্তু থেমে যায় রহস্যজনক কারনে। গতানুগতিক ধারায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে আমরা দখলমুক্ত করার চেষ্টা করতে কার্পণ্য করি না, কিন্তু পারি না। কারন প্রভাবশালীদের চাপ থাকে, দখলদাররা কাগজপত্র ও দলিল তৈরী করে রাখে, এমনকি আদালতে মামলাও ঠুকে দেয়। ভৈরব নদ দখল করে তৈরী হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ী। দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন নদ দখলমুক্ত করতে গিযে বরাবরই এক পা এগুলে দুই পা পিছিয়ে আসে। বিশাল বিশাল ইমারত তৈরী হয়েছে প্রশাসনের চোখের সামনেই। শুকিযে যাওয়া নদের বুকে চলছে চাষাবাদও। কাগজপত্র ঘাটলেই দেখা যাবে কারোরই পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, অথচ বিশাল বিশাল অট্রালিকা গড়ে তোলা হয়েছে নদীর জমিতে। একইভাবে দখল হয়েছে নবগঙ্গা, কুমার, মুক্তেশ্বরী, কপোতাক্ষ ও চিত্রাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের নদ-নদী।

https://www.dailyinqilab.com/article/80778/