২৪ মে ২০১৭, বুধবার, ৭:৫৬

শ্রমিক লীগ ও পুলিশের যৌথ দখলবাণিজ্য

রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিং এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে অবৈধভাবে দোকানপাট ও কাপড়ের বাজার গড়ে ব্যবসা করছেন শ্রমিক লীগের নেতারা। ফ্লাইওভারের নিচে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) ঘিরেই 'শ্রমিক লীগ ক্লাবে'র ব্যানারে নেতাদের ছত্রছায়ায় শতাধিক অবৈধ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। আর কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকায় ৩০০ ফিট রাস্তায় গাড়ি রাখায় অবৈধ দুটি স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছেন। গত বছর থেকে নিয়মিত এই স্ট্যান্ড থেকে কাঞ্চন ব্রিজ ও নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়ায় যাত্রী আনা-নেওয়া করা হয়। একইভাবে গাউছিয়ায়ও রয়েছে শ্রমিক লীগের আরেকটি অবৈধ প্রাইভেটকারের টার্মিনাল।

এখানকার প্রাইভেটকার চালক কাউসার আহমেদ জানান, এখানে গাড়ি রাখতে হলে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়। প্রতি মাসে জমা দিতে হয় ১৫শ' টাকা। এর মধ্যে একহাজার টাকা চলে যায় কুড়িল-বিশ্বরোডের পুলিশের হাতে। অন্য ৫০০ টাকা গাউছিয়ার শ্রমিক নেতারা নেন। এ ছাড়া প্রতিদিন পুলিশকে চাঁদা হিসেবে ১২০ টাকা দিতে হয়। দেলোয়ার নামে এক কর্মচারী এ কাজে সহযোগিতা করেন। কাউসার আরও জানান, কাগজপত্র ঠিক থাকলে চালক কমিশনের ভিত্তিতে গাড়ি চালাবেন। এ ক্ষেত্রে গাড়ির মালিক লাভবান হবেন। কাগজপত্র ঠিক না থাকলে চালকই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। এ ক্ষেত্রে মালিককে প্রতিদিন জমা দিতে হয় ৫০০ টাকা।

ভাড়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ফ্লাইওভারের নিচ থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা ও নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া পর্যন্ত ভাড় ৮০ টাকা।'

সরেজমিন দেখা যায়, যেসব ব্যক্তিগত গাড়ি এখানে রাখা হয়েছে সবই ভাঙাচোরা, ফিটনেসবিহীন। কোনো গাড়িরই সঠিক কাগজপত্র নেই। অনেক গাড়ির ইঞ্জিনও চোরাই। এসব গাড়ি মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হয়।

ফ্লাইওভারের নিচে এ রকম অঘোষিত টার্মিনাল নির্মাণ করে পরিবেশ নষ্ট

করায় স্থানীয় কুড়াতলীর বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ। কয়েকজন জানান, আগে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করায় অভিযুক্তরা তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেন।

শনিবার সন্ধ্যায় কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিং এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় পঞ্চাশের অধিক টং দোকানে চা-পান-সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া অসংখ্য ভাসমান ভ্যানে করে পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। আবার কেউ কেউ রাস্তা দখল করেই ঝালমুড়ি, বাদাম, হালিমের দোকান পেতে বসেছেন। এ জন্য প্রত্যেক হকারকে প্রতিদিন শ্রমিক লীগের সমিতিতে দিতে হয় চাঁদা বাবদ ২২০ টাকা। তবে নতুন করে কেউ দোকান গড়তে চাইলে বা ভ্যান রেখে ব্যবসা করতে চাইলে তাকে দিতে হয় এককালীন ৫ হাজার টাকা। সন্ধ্যার পরপরই প্রত্যেক দোকানির কাছ থেকে এই চাঁদা সংগ্রহ করে এলাকার 'লাইনম্যান' লিটন।

এ বিষয়ে লিটনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'রেলক্রসিং এলাকায় এখন তো মামা জায়গা খালি নাই। পুরান ব্যবসায়ীদেরই জায়গা দিতে পারছি না। নতুনদের কীভাবে দেব?'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানি জানান, এখানকার প্রতিটি দোকানের টাকার ভাগ লাইনম্যানের মাধ্যমে শ্রমিক নেতারা পেয়ে থাকেন। এর একটি ভাগ পুলিশও পায়। তবে তিনি শ্রমিক নেতাদের নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, 'জায়গা না থাকলেও ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ঠিকই তারা দোকান বসানোর সুযোগ করে দেবে।'

তবে পুলিশের দাবি, মূল রাস্তার পাশে যেসব অবৈধ দোকান ছিল তা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন কাউকেই বসতে দেওয়া হচ্ছে না। তাছাড়া মিরপুর, রাজারবাগ, ভাটারা থানার পুলিশ এখানে কাজ করেন। তাই কে, কখন টাকা নিচ্ছেন_ তা জানা নেই। তবে রেলক্রসিং এলাকার শ্রমিক লীগের ক্লাবের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে।

ক্রসিংয়ের পাশে গড়ে তোলা টং দোকানি সজীব মিয়া বলেন, 'নেতাদের চাঁদা আর বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতিদিন ৩০০ টাকা জমা দিই। পুলিশকে দিই ৪০-৬০ টাকা। সব খরচ বাদে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা থাকে।'

এ ব্যাপারে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'কুড়িল-বিশ্বরোড এলাকা ভাটারা থানার অধীনে পড়েছে।' ভাটারা থানার ওসি নূরুল মোত্তাকিন বলেন, 'ফ্লাইওভারের দক্ষিণ অংশ আমাদের থানার অধীনে। আর এই অংশটি পুরোপুরি অবৈধ স্থাপনামুক্ত আছে। এ ছাড়া ৩০০ ফিটের অংশটি খিলক্ষেত থানার অধীনে রয়েছে।'

খিলক্ষেত থানার ওসি মো. শহীদুল হক বলেন, 'এপ্রিল মাসেই রাজউক, ট্রাফিক বিভাগ, ডিএনসিসি ও টার্মিনালের চালকদের সঙ্গে যৌথ সভা হয়েছে। যেহেতু ভুলতা-গাউছিয়ায় চলাচলের জন্য এটি একমাত্র রাস্তা। তাই তাদের লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোজার ঈদের পরপরই এই টার্মিনালটি উচ্ছেদ করা হবে।' তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন চাইলে আমরা আমাদের ফোর্স দিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যেই উচ্ছেদ করতে পারি। আর এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক বিভাগের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।' 

http://bangla.samakal.net/2017/05/24/295043#sthash.TExoEzRn.dpuf