২২ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:২৮

রমযানের আগেই কয়েক দফা বেড়েছে সব জিনিসপত্রের দাম

# মন্ত্রণালয়ের কথার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না ভোক্তা # নতুন চাল বাজারে আসলেও দাম কমছে না # এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব জিনিসের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা 

 রমযান আসার আগেই কয়েক দফা বেড়ে গেছে চাল, চিনি ও ছোলাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। বিক্রেতারা অনেকটা রসিকতা করে বলছেন রমযানে আর জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। কারণ রমযানের আগেই কয়েক দফা বেড়ে গেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কয় দিনে নিত্য পণ্যের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তা বিগত ৫ বছরের ইতিহাসকে হার মানিয়েছে। মাসজুড়ে এসব পণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রশাসনের নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবে রমযান শুরুর প্রায় এক সপ্তাহ আগেও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে প্রায় সব ধরনের পণ্য। তবে বাণিজ্য মন্ত্রী দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, রমযান মাসে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
নতুন চালেও দাম কমছে না : রাজধানীর বাজারে নতুন বোরো চাল আসতে শুরু করেছে। তবে পুরোনো চালের মতো এই চালের দামও চড়া। যদিও আশা করা হয়েছিল, নতুন মৌসুমের ধান উঠলে বাজারে চালের দাম কমবে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি নতুন মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা দরে। সরু চাল কেজি প্রতি ৫২ টাকার আশপাশে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। মৌসুমের শুরুতে দাম তো কমেইনি, বরং ভবিষ্যতেও কমার কোনো আশা দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এ বছর ধানের দাম বেশি, তাই চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমার সম্ভাবনা কম।
এ কারণে কয়েক মাস ধরে চাল কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষ যে অস্বস্তিতে ভুগছে, তা দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় মোটা চালের দাম এখন ৩৬ শতাংশ বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর চালের অন্যতম পাইকারি বাজার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে বোরোর পুরোনো চাল নেই বললেই চলে। সেখানে হাইব্রিড মোটা চাল নামে পরিচিত চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা কেজি দরে। মোটা চালের আর দুই জাত গুটি ও স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৬ টাকা দরে। বিআর আটাশ নামের মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬-৪৭ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে মিনিকেট নামে পরিচিত সরু চাল ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারেও নতুন চাল এসেছে। অবশ্য দাম কৃষি মার্কেটের আড়তের চেয়ে কিছুটা বেশি।
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম বেড়েছে আরেক দফা। রমযানকে সামনে রেখে এই দাম বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের। খুচরা বাজার ভেদে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৪ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৭২-৭৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশের বাজারে সাধারণত সরকারি মিলের লালচে দানার চিনি ও বেসরকারি মিলের সাদা দানার চিনি পাওয়া যায়। বর্তমানে শুধু সাদা দানার চিনির দাম বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমযান আসলে নিত্যপণ্যের বাজারের চাহিদা বেড়ে যায়, তবে চিনির দামটা গত বছরের চাইতে এবছর অনেক বেশি। মিল মালিকদের কারসাজির জন্য হতে পারে তবে আমরা আগের দামে চিনি বিক্রি করি।
এদিকে গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, আসন্ন রমযানে চাহিদার তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বেশি মজুদ থাকায় দাম স্বাভাবিক থাকবে। তিনি জানান, রমযান উপলক্ষে চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ, ছোলা, রসুনসহ নিত্যপণ্য চাহিদা মাফিক পর্যাপ্ত মজুদ আছে। কোনো পণ্যের সংকট বা সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না। গতকাল রাজধানীর পল্টনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনে আমদানি রফতানি দফতরের প্রধান নিয়ন্ত্রকের অফিস উদ্বোধন উপলক্ষ্যে দেওয়া বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
সম্প্রতি সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, রমযানে কোনো পণ্যের সংকট তৈরি হবে না। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এছাড়া ওই সময় কেউ যদি পণ্যের দাম বাড়ানোর কারসাজি করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিন্তু বাজারে এ আশ্বাসের কোনো প্রতিফলন নেই। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে চাল, ডাল, ছোলা, আদা রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০-২০ টাকা করে।
দেখা যায়, গত সপ্তাহে যে ছোলা প্রতি কেজি ৭৪-৮৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে; তা এ সপ্তাহে ১০-২০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৫-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিনি গত সপ্তাহে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হলেও চলতি সপ্তাহে তা ৬-১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমযান মাস সামনে রেখে বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র। সরবরাহ পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকার পরও সরবরাহে ঘাটতি, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, হাওর অঞ্চলে ফসলহানির মতো নানা অজুহাত তুলে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং সময় সময় বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশের নিত্যপণ্যের দাম সমন্বয় করার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
মাছের বাজার ঘুরেও দেখা গেছে দাম বেশ চড়া। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি রুই বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়। আর এ সপ্তাহে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায়। প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১২০০ টাকায়।
গত সপ্তাহে গরুর গোশত প্রতি কেজি ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। এ সপ্তাহে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে তা বিক্রি হচ্ছে ৪৯০ থেকে ৫১০ টাকা করে। খাসির গোশত প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা করে। ব্রয়লার মুরগি কেজিতে কমেছে ৫ থেকে ১০ টাকা। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা করে। দেশী মুরগি প্রতি কেজি ৩৭০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সয়াবিন তেল লুজ প্রতি লিটার ৮২-৮৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, ১ লিটারের বোতল ১০০-১০৬ টাকা, ৫ লিটারের বোতল ৪৯০-৫২০ টাকা, পাম অয়েল লুজ প্রতি লিটার ৭০-৭২ ও পাম অয়েল সুপার প্রতি লিটার ৭৪-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহেও একই দামে বিক্রি হয়েছে এসব ভোজ্য তেল।
অন্যদিকে মসুর ডাল প্রতি কেজি ৭৫ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডাল তুরস্ক-কানাডা-বড় দানা গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ সপ্তাহে ৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে তা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়।
মাঝারি ধরনের ডাল তুরস্ক-কানাডা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। দেশি ডাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০-১২০ টাকায়। নেপালি ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকা কেজি দরে। মুগডাল মানভেদে প্রতি কেজি ৯০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; গত সপ্তাহে যা বিক্রি হয়েছে ১১০-১৩৫ টাকায়।
প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকা, আমদানি করা পেঁয়াজ ২৫-৩০, রসুন ১৫০-২৪০, শুকনা মরিচ ১৫০-২০০, হলুদ ১৬০-২০০, আদা আমদানি করাটা মানভেদে প্রতি কেজি ৭০-১১০, জিরা প্রতি কেজি ৩৮০-৪৫০, দারু চিনি ৩২০-৩৬০ ও এলাচ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০০-১৬০০ টাকায়। ধনিয়ার পাতা ১২০ থেকে ১৫০ ও তেজপাতা প্রতি কেজি ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি কেজি টমেটো ৫০ টাকা, সাদা বেগুন ৫০-৬০, কালো বেগুন ৬০, শসা ৪৫-৫০, কচুরলতি ৬০, পোটল ৬০, ঢেঁড়স ৬০, ঝিঙা ৬০, চিচিঙ্গা ৬০, করলা ৫০, কাঁকরোল ৫০, আলু ১৮-২০, পেঁপে ৪০-৫০ ও কচুরমুখি ৬০ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, পাইকারি বাজারে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ১০ টাকা বেড়েছে।
ভোজ্যতেল : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন প্রায় আড়াই লাখ টন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত সয়াবিন ও পামঅয়েল আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে হয়। প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ ১০ হাজার টন সয়াবিন ও পামঅয়েলের দেশীয় চাহিদা ছাড়াও রমযান ও ঈদুল আজহায় বাড়তি চাহিদার সৃষ্টি হয়।
গত বছরের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সবধরনের ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল ও নিম্নমুখী থাকায় দেশীয় বাজারে দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৯ লাখ ১৯ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ১৭ লাখ এক হাজার টন ভোজ্যতেল দেশে আনা হয়েছে। ফলে মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ছোলা : অভ্যন্তরীণ মার্কেটে আস্ত ছোলার চাহিদা ৬০ হাজার টন। এর মধ্যে সাত হাজার টন দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ডালসহ ছোলা তিন লাখ ৫৫ হাজার টন দেশে আমদানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দুই লাখ ৪৫ হাজার টন ডালসহ ছোলা আমদানি হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এক লাখ চার হাজার টন আস্ত ছোলার এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। স্থানীয় বাজারে ছোলার মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

 

http://www.dailysangram.com/post/284827-