২২ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:২২

‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ না দেয়ার আহ্বান

আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ষোড়শ সংশোধনীর শুনানি শুরু

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়েছে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয়া হয়। রোববার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়।


বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন : বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। আজ সোমবার এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

এদিন শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারপতি বলেন, উভয় পক্ষের আইনজীবীরা রয়েছেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ না রাখাই ভালো। যদি কেউ রাখেন তা গ্রহণ করা হবে না। আর কোর্টের উদ্দেশে শুনানি করবেন। আদালতের শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ মামলায় যাদের অ্যামিকাসকিউরি করা হয়েছে তাদের কেউ কেউ মার্শাল ল’ প্রক্রিয়ায় জড়িত।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা জেনেশুনেই অ্যামিকাসকিউরি (আদালতকে আইনি মতামতদানকারী) নিয়োগ করেছি। সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে যারা আদালতকে সহযোগিতা করতে পারবেন তাদেরই অ্যামিকাসকিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যখন নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তখন এ ব্যাপারে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে বলতে পারতেন, কিন্তু এখন কেন? বাড়তি দু-একজন অ্যামিকাসকিউরির প্রয়োজন থাকলে বলতে পারেন।

অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা একশ’ জনও যদি এক পক্ষে বলেন এবং সেটি যদি আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে তা গ্রহণ করা হবে না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অ্যামিকাসকিউরিদের বক্তব্য দেখার পরই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি। আর সাংবিধানিক বিষয়ে কথা বললে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ ও রাজনৈতিক বিষয় আসবে। তাহলে কি এগুলো নিয়ে কথা বলা যাবে না?

প্রধান বিচারপতি বলেন, যাবে। তবে মামলার মূল বিষয়বস্তু ছাড়া কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া যাবে না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি সেদিন জঘন্যতম একটি গালি শুনেছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, সেটা তো সমাধান হয়ে গেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না হয়নি। রক্তক্ষরণ হতেই থাকবে। এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন।

শুনানিতে মুরাদ রেজা বলেন, এই রিট আবেদনটা মেনটেইনেবল (গ্রহণযোগ্য) ছিল না। ১৮ বিএলসিতে আপিল বিভাগ একটি রূপরেখা দিয়ে বলে দিয়েছেন, কোন বিষয়গুলো নিয়ে জনস্বার্থে কেউ মামলা করতে পারবেন। সেই রূপরেখা অনুযায়ী এটি কোনো অবস্থাতেই জনস্বার্থের আওতায় পড়ে না। এ সময় তিনি ১০ বিচারপতির রায়ের উদাহরণ টেনে আনেন। তিনি বলেন, ওই মামলাটা পাবলিক ইন্টারেস্টে (জনস্বার্থে) করা হয়েছিল। সংক্ষুব্ধ ১০ বিচারপতিই সেটা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগে যখন যায়, তখন সিটিং অনেক বিচারপতিই সেখানে চলে আসেন, কারণ তারা সুপারসিটেড হবেন বলে মনে করেন। এখনও সংক্ষুব্ধ হয়ে যদি কোনো বিচারপতি মনে করেন, এটা না হয়ে ওটা হতে পারে তাহলেও তিনি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। এখানে একমাত্র সংক্ষুব্ধ হলেন বিচারক। এ মামলাটি কিন্তু জনস্বার্থে ছিল না। এ দুটি দিক বিবেচনায় ষোড়শ সংশোধনীর মামলাটিও জনস্বার্থের মামলা হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, এ মামলাটি প্রিম্যাচিউর। একটি শিশু জন্মের আগেই তা মেরে ফেলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, একটা আইন হবে। এ আইনের আওতায় বিচারপতিদের অপসারণ করা হবে। ওই আইন না দেখেই, ৯৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আইনে বিচারপতিদের কিভাবে অপসারণ করা হবে, সেটা ভালো না খারাপ আগে দেখা উচিত ছিল। কিন্তু সে পথে না গিয়ে আইন হওয়ার আগেই এটার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এটাও হাইকোর্ট দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর আলোকেই করা হয়েছে উল্লেখ করে মুরাদ রেজা বলেন, এটার সৃষ্টিই হয়েছে সংবিধানের মূল কাঠামো দিয়ে। গণপরিষদে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুনানি করে এটাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। মাঝখানে মার্শাল ল’ অথরিটি বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারাই এ সংবিধানকে বিকৃত করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ঢুকিয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা সংবিধানের মূল জায়গায় ফিরে গিয়েছি। এটা মূল সংবিধানের অংশই ছিল। এতে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মূল ধারায় ফিরে যাওয়া কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক হতে পারে না। হাইকোর্ট বিভাগ একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে রায় দিয়েছেন। এরপর সোমবার (আজ) পরবর্তী শুনানির জন্য ধার্য করা হয়।

জানা গেছে, বাহাত্তরের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। এরপর জিয়াউর রহমানের সময় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়।

এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। এ আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে গত বছর ৫ মে ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। তিন বিচারকের মধ্যে দু’জন ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন এবং একজন রিট আবেদনটি খারিজ করেন। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গত বছরের ২৮ নভেম্বর আপিল দায়ের করেন। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আপিল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাসকিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। এরা হলেন : বিচারপতি টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূইয়া ও এমআই ফারুকী। গত ৮ মে থেকে এ আপিলের শুনানি শুরু হয়।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/22/126475/