১৯ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩৩

আ’লীগের এমপি হারুনই মালিক

রেইনট্রির বৈধতা না থাকায় সিলগালা করেছিল রাজউক

আবাসিক ভবনের অনুমোদনে হোটেল নির্মাণ * বাণিজ্যিক সুবিধা চেয়ে গণপূর্তমন্ত্রীকে ডিও লেটার দিয়েছিলেন এমপি

রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝালকাঠি-১ আসনের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনই (বিএইচ হারুন) ঢাকার বনানীর আলোচিত হোটেল রেইনট্রির মালিক। চার তারকা এ হোটেলটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান এবং রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া রেইনট্রির জন্য নানা সুবিধা পেতে গণপূর্তমন্ত্রীকে ডিও (আধা সরকারি) লেটার দিয়েছিলেন এমপি হারুন। এরপর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে হোটেলটির নির্মাণ শেষ করে এটি চালু করা হয়। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক হোটেল নির্মাণের বৈধতা না থাকায় এটি সিলগালা করে দেয় রাজউক। কেটে দেয়া হয় রেইনট্রির পানি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের দেয়া স্থগিতাদেশের দোহাই দিয়ে নিজেরাই ওই সিলগালা খুলে ফেলে ও প–নঃস্থাপন করে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির লাইন। তাদের এ কাজটি পুরোপুরি বেআইনি বলেও জানিয়েছেন রাজউকের কর্মকর্তারা।
হোটেল রেইনট্রিতে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় শুরু থেকেই আড়ালে থাকার চেষ্টা করে হোটেলটির মালিকপক্ষ। একপর্যায়ে জানা যায়, ধর্ষণকারীদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে হোটেল মালিকপক্ষের একজন মাহির হারুনের। যিনি জাতীয় সংসদের ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের এমপি বিএইচ হারুনের ছোট ছেলে। ধর্ষিত দুই তরুণীর বক্তব্য অনুযায়ী ঘটনার রাতে মাহির হারুন হোটেলের আলোচিত ওই কক্ষে গিয়ে ধর্ষকদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান। ধর্ষক সাফাতের জন্মদিন উপলক্ষে ওই রাতে একটি বড়সড় কেকও উপহার দেন তিনি। এ সময় দুই তরুণীকে ধর্ষকরা বলে, ‘ওর বাবা একজন এমপি এবং এ হোটেলের মালিক। এখানে আমাদের কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।’
মাহির হারুনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সামনে আসার পর হোটেল দ্য রেইনট্রি এবং ওই রাতের ঘটনার সঙ্গে আলোচিত হতে থাকে এমপি বিএইচ হারুনের নাম। বিষয়টি নিয়ে এমপি হারুন ও তার ছেলেদের সঙ্গে বহুভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মিডিয়াসহ অপরিচিত সবার সঙ্গে যোগাযোগ, কথা বলা বন্ধ করে দেন এমপি হারুন এবং তার পরিবারের সদস্যরা। কয়েক দিনে একাধিকবার মোবাইলে ফোন আর ক্ষুদেবার্তা দেয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। তবে বিএইচ হারুন দলের সিনিয়র নেতাদের নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, ওই হোটেলটির মালিক তিনি নন। তার ছেলেমেয়েরা এটি চালায় আর তারাই মালিক। তিনি হোটেলটির ব্যাপারে ভালো করে কিছু জানেনও না। কিন্তু মূল বিষয়টি ফাঁস হয় মঙ্গলবার হোটেল রেইনট্রির সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আল হুমায়রা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, হোটেল রেইনট্রি আল হুমায়রা গ্রুপের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত। এই আল হুমায়রা গ্রুপের চেয়ারম্যান বিএইচ হারুন। একমাত্র কন্যা হুমায়রার নামে এ গ্রুপটি করেছেন তিনি। এ গ্রুপের মালিকপক্ষের সবাই এমপি বিএইচ হারুনের পরিবারের সদস্য। এমনকি তার মেয়ে হুমায়রাও হোটেল রেইনট্রির একজন পরিচালক। এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন বিএইচ হারুনের আরেক ছেলে আদনান হারুন। মাহির হারুন হোটেলের একজন পরিচালক। কিন্তু হোটেলটির চেয়ারম্যান কে সে সম্পর্কে মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, হুমায়রা গ্রুপের চেয়ারম্যান বিএইচ হারুনই এ হোটেলটির চেয়ারম্যান।
এমপি বিএইচ হারুন যে রেইনট্রির মালিক তার জোরালো প্রমাণ মেলে রাজউক থেকে পাওয়া তথ্যে। বনানী আবাসিক এলাকার কে-ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর প্লটে যে জমিতে এটি নির্মিত হয়েছে সেই প্লটের মালিক বিএইচ হারুনের স্ত্রী মুনিরা আক্তার। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫ কাঠার ওই প্লটটি কেনা হয়। হুমায়রা গ্রুপের অর্থায়নেই জমিটি কেনা হয় তার নামে। যে গ্রুপের চেয়ারম্যান এমপি বিএইচ হারুন। রেইনট্রি নির্মাণের আগে প্ল্যান অনুমোদনের জন্য জমির যে দলিল রাজউকে জমা দেয়া হয় তাতে মালিক হিসেবে লেখা রয়েছে মুনিরা আক্তারের নাম। ২০০৫ সালের ৩০ জুলাই আবাসিক এলাকার প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর অভিযোগে রাজউক থেকে চিঠি দেয়া হয় মুনিরা আক্তারকে। বহু দেনদরবার শেষে ২০০৬ সালের ৫ এপ্রিল ওই অভিযোগ থেকে মুক্তি পান তিনি। একই সঙ্গে ভবনের সংশোধিত নকশাসহ নতুনভাবে প্ল্যান পাস করতে আবেদন করা হয় রাজউকে। আবাসিক কার্যক্রম পরিচালনার শর্তে ২০১১ সালের ৩১ জুন মুনিরা আক্তারকে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় ভবন নির্মাণ আর সে ভবনেই অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয় হোটেল রেইনট্রি। এমপি হারুনের নির্বাচনী এলাকা কাঁঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তরুন সিকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘উনি (এমপি হারুন) কথায় কথায় বলেন, উনার ছেলেমেয়েরা এ হোটেলের মালিক। এখন আবার শুনছি হোটেলের জমি উনার স্ত্রীর নামে। খুঁজে দেখা প্রয়োজন যে বনানীতে ৫ কাঠা জমি কেনা আর এতবড় ৪ তারকা হোটেল করার টাকা তারা কোথায় পেয়েছে। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
জানা গেছে, হোটেল নির্মাণের পর বৈধতা পেতে মাঠেও নেমেছিলেন হারুন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রীর কাছে দেয়া এক ডিও লেটারে রেইনট্রি যে প্লটে অবস্থিত সেটি বাণিজ্যিকীকরণের অনুরোধ করেন তিনি। নানা যুক্তি ও ব্যাখ্যা উল্লেখ করে প্রয়োজনে রাজউকের নির্ধারিত ফি প্রদানের অঙ্গীকারও করা হয় ওই ডিও লেটারে।
অবশ্য এই ডিও লেটারে কোনো কাজ হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকে চিঠিটি গেলেও আলোচ্য প্লটের রাস্তা ছোট হওয়ায় সেটিকে বাণিজ্যিক প্লটের মর্যাদা দেয়া হয়নি। এরপরও রেইনট্রি নামে আবাসিক হোটেলের কার্যক্রম শুরু করে আল হুমায়রা গ্রুপ।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে বাণিজ্যিক হোটেল নির্মাণ করায় রেইনট্রি সিলগালা করা হয়। এ বছর ৯ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে হোটেল উদ্বোধনের পর ১৫ এপ্রিল অভিযান পরিচালনা করে রাজউক। অভিযান পরিচালনাকারী রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার অলিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কোনো বৈধতা না থাকার পাশাপাশি অনুমতিহীন হোটেল পরিচালনার ঘটনায় অভিযান চালিয়ে এটি সিলগালা করে দিই। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দিই এর পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন।’ রাজউক অঞ্চল-৪-এর অথরাইজড কর্মকর্তা আদিলুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সিলগালা করে দিলেও পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ওই সিলগালা খুলে পুনরায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে।’
হোটেল রেইনট্রি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে, রাজউকের নেয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় নেয়া হলে সেখান থেকে দেয়া স্থগিতাদেশ অনুযায়ী সিলগালা খুলে ফেলা হয়। বিষয়টি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। রাজউকের আইন শাখার পরিচালক রোকন-উদ দৌলা যুগান্তরকে বলেন, ‘আদালত যদি স্থগিতাদেশ বা সিলগালা খুলে ফেলতেও বলেন, তবে সেই নির্দেশ পালন করবে রাজউক। কিন্তু সেটা খোলার কোনো আইনগত অধিকার নেই রেইনট্রি কর্তৃপক্ষের।’ রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘অবৈধ হওয়ায় রেইনট্রি আমরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এটির বৈধতা পাওয়ার সুযোগ কম। আমি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
প্রসঙ্গত রাজধানীর বনানী এলাকায় শুধু কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ ও ১১ নম্বর সড়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। এ দুটি এলাকাতেও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি দিয়ে রাজউকের অনুমোদন নিতে হয়। আর হোটেল রেইনট্রি যে সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করার কোনো সুযোগ নেই।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/05/19/125670/