১৯ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৮

টাকার অভাবে শিক্ষকরা অবসর ভাতা পাচ্ছেন না

বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসর নেওয়ার পর বছরের পর বছর অবসর ভাতার অপেক্ষায় থেকে বৃদ্ধ বয়সে অপরিসীম কষ্টে আছেন। তাদের অবসরকালীন সুবিধা দেওয়ার জন্য গঠিত 'বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড' এবং 'বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট' নামক প্রতিষ্ঠান দুটি প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। প্রতি মাসে সারাদেশে গড়ে অবসর নেন পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী। চাহিদা মেটাতে দুই বোর্ডের লাগে মাসে গড়ে ৩৬ কোটি টাকা। আয় মাত্র ১৮ কোটি টাকা।

সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশন আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যারা এমপিওভুক্ত তথা সরকারি তহবিলের বেতন পান, তারাই কেবল অবসর ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত। এদের সংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। ২০০২ সালের একটি আইনে এ সুবিধা প্রবর্তিত হয়।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মাসিক বেতন থেকে ৪ শতাংশ হারে কেটে রাখা চাঁদা ও ব্যাংকের মুনাফা থেকে অবসর ভাতার অর্থের জোগান হয়। অবসর ভাতা দিতে প্রতি মাসে প্রয়োজনের অর্ধেক ঘাটতি থাকায় যতজন শিক্ষক-কর্মচারী আবেদন করেন তাদের অর্ধেককে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা জমতেই থাকে। জমতে জমতে এখন আবেদনের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১২ সালে করা আবেদন পাঁচ বছর পরে এখন নিষ্পত্তি হচ্ছে। অবসরে যাওয়ার পর সাড়ে তিন থেকে চার বছর লাগছে টাকা পেতে। সারাজীবন

শিক্ষকতার চাকরি শেষে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এটাই যৎসামান্য আর্থিক প্রাপ্তি। বয়োবৃদ্ধদের অনেকে গুরুতর অসুস্থ। অনেকে মৃত্যুর আগে ভাতা পান না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৭তম সভায় অবসর বোর্ড নিয়ে সাংসদরা বিশদ আলোচনা করেন। তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বন্ধ্যত্ব ঘুচাতে সেখানে বিশেষভাবে সরকারি বরাদ্দ দরকার।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা আইন-২০০২ অনুযায়ী, অবসর সুবিধা বোর্ড পরিচালনা বিষয়ে প্রবিধানমালা-২০০৫ প্রণীত হয়। এ প্রবিধানমালার ধারা ১০(১) অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ২০০২ সালের পহেলা ডিসেম্বর থেকে চালু হয়। ১৯৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে প্রতি বছর চাকরির জন্য ২ মাস এবং ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছরের জন্য ৩ মাসের সরকার প্রদত্ত বেতন, সর্বোচ্চ ২৫ ধরে চাকরিকাল গণনা করে সেই পরিমাণ টাকা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের বয়স ৬০ বছর অথবা চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হলে পূর্ণ অবসরপ্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করেন।

ঘাটতির কারণ :জানা গেছে, অবসর সুবিধা বোর্ড প্রতিষ্ঠার সময় সরকার থেকে দেওয়া ৮৯ কোটি টাকার অর্জিত মুনাফা শুধু অফিস পরিচালনা বাবদ খরচ করার অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতনের ৪ শতাংশ হারে কর্তন থেকে আয় এখন ১৮ কোটি টাকা হলেও মাসিক জমাকৃত আবেদন নিষ্পত্তির জন্য লাগছে ৩৬ কোটি টাকা। এই ঘাটতি চলতে থাকা অবস্থায় ২০১৫ থেকে অষ্টম নতুন জাতীয় পে স্কেল অনুযায়ী বেতন বাড়ায় ঘাটতিও বেড়েছে।

অবসর সুবিধাবোর্ডের পরিচালক খসরুল আলম সমকালকে জানান, ১৯৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে অবসর সুবিধা দেওয়া হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে চাঁদা কর্তন শুরু হয় ২০০৫ সাল থেকে। বর্তমানে অবসর সুবিধা বোর্ডে ৩৯ হাজার ৮৩৩টি আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে বর্তমান ঘাটতি ১ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। মূলত প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ না থাকায় বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবসর গ্রহণকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য অবসর ভাতা পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে।

উল্লেখ্য, আগের আবেদন আগে বিবেচনার কঠোর নীতি অনুসরণ করা হলেও আবেদনকারী হজ অথবা তীর্থযাত্রী হলে, অসুস্থ ক্যাটাগরিতে জটিল রোগী হলে, মুক্তিযোদ্ধা হলে এবং মৃত শিক্ষক-কর্মচারীর পরিবার হলে তাদের আবেদন বিশেষ বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করা হচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের অনিষ্পন্ন আবেদন নিষ্পত্তির জন্য বর্তমান ঘাটতি বাবদ প্রয়োজনীয় টাকা প্রদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রতি মাসে মোট ৬০০ কোটি টাকা মুনাফার লক্ষ্যে (আনুমানিক ১০% হারে সুদ হিসেবে) সিড মানি বাবদ এককালীন বরাদ্দ অথবা অবসর সুবিধা আইন ৯(১) (ক) অনুযায়ী প্রতি বছর সরাসরি জাতীয় বাজেটে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত বছর অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বহু বছর পর ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বাজেটে বেসরকারি শিক্ষকদের কল্যাণে 'বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবসর সুবিধা বোর্ড'-এর অনুকূলে ৫০০ কোটি টাকা এনডাওমেন্ট ফান্ড এবং ১০০ কোটি টাকা এককালীন অনুদান দেওয়া হয়। এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ ফান্ডের অনুকূলে এককালীন ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দও দেয় সরকার। এতে কিছুটা সুরাহা হলেও নতুন বেতন স্কেল কার্যকর করায় অর্থ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আবারও ঘাটতির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে এ দুটি প্রতিষ্ঠান।

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু সমকালকে বলেন, কল্যাণ ট্রাস্টে ৩০ হাজারের বেশি আবেদন অনিষ্পন্ন আছে। অর্থ ঘাটতির কারণেই এমনটি হয়েছে। বর্তমানে তারা ২০১৪ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে আবেদন করা শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদন নিষ্পত্তি করছেন।

অপর দিকে, অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী বলেন, ২০১২ সালের ডিসেম্বরের আবেদন তারা এখন নিষ্পত্তি করছেন। ২০১৩ সালের আবেদনে শিগগিরই হাত দেবেন। তিনি বলেন, '২০১৭ সালে এসে চার বছর আগের অর্থ দিতে আমাদেরও খুব খারাপ লাগে। শিক্ষকদের নিদারুণ কষ্ট হয়। তাই শিক্ষকদের বেতনের চাঁদার পরিমাণ ৪ শতাংশ থেকে শিগিগরিই ৬ শতাংশে উন্নীত করা হবে।'

এ দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইনও জানান, শিক্ষকদের বেতনের চাঁদার অংশ ২ শতাংশ বাড়িয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এতে সমস্যা অনেকখানি মিটবে।

ভুক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আরও অভিযোগ, দুই প্রতিষ্ঠানের অর্থ পেতে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়; ঘুষ দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই চেক তৈরি হয়ে যাওয়ার পরও ঘুষ ছাড়া তা ইস্যু করা হয় না। বিশেষ করে অবসর বোর্ডের কয়েক কর্মকর্তা, পিয়ন, ড্রাইভারের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওই দপ্তরে অর্থ ছাড়া ফাইল নড়ে না।

http://bangla.samakal.net/2017/05/19/293735#sthash.j8OomLri.dpuf