১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:০৭

লুটপাটে বাড়ছে খেলাপি ডুবছে ব্যাংক

প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে, আরও বাড়ার আশংকা ঋণের নামে সরকারি ব্যাংকে টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে খেলাপির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারছে না ব্যাংকিং খাত। বরং দিনে দিনে বাড়ছে খেলাপি ঋণের বোঝা। তিন মাস পর এবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সে পরিসংখ্যানও খুবই উদ্বেগজনক। গত জানুয়ারির আগে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ থাকলেও মার্চে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে ৪২ হাজার কোটি টাকার অবলোপন যোগ করলে দাঁড়াবে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে জুনেও নিশ্চিতভাবে এমন নেতিবাচক সংবাদ শুনতে হবে।
দুঃসংবাদ এখানেই শেষ নয়, খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে ব্যাংকের তহবিলে যে বিশেষ সঞ্চিতি বা সঞ্চয় রাখতে হয় সেখানেও ব্যর্থ হয়েছে ৬টি ব্যাংক। এর মধ্যে সরকারি ৩টি ও বেসরকারি ৩টি। অর্থাৎ খেলাপি, অবলোপন ও প্রভিশনের মানদণ্ডে ব্যাংকগুলো যেন চোরাবালিতে আটকা পড়েছে।
জানা গেছে, প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, বেসিক ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। ব্যাংক তিনটির প্রভিশন ঘাটতি ৬ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের বিচার না হওয়ায় সীমাহীন দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। কার্যত লুটপাটে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। পরোক্ষভাবে যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। এভাবে ব্যাংকগুলোও ডুবতে বসেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ঋণের নামে সরকারি ব্যাংকে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সে কারণে প্রভিশন ঘাটতি সবচেয়ে বেশি সরকারি ব্যাংকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি ৭ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখার কথা ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু প্রভিশন রেখেছে ১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বেসিক ব্যাংক। একইভাবে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১০ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখার কথা ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। কিন্তু প্রভিশন রেখেছে ৪ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এতে ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। রূপালীর খেলাপি ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। ২ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার পরিবর্তে রেখেছে মাত্র ১ হাজার ১ কোটি টাকা। এছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ১ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ১ হাজার ২০৯ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার পরিবর্তে ব্যাংকটি রেখেছে মাত্র ৬৯৮ কোটি টাকা। এতে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫১১ কোটি টাকা। একইভাবে প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ৭১৭ কোটি টাকা। ৪৪৬ কোটি টাকার পরিবর্তে ব্যাংকটি প্রভিশন রেখেছে মাত্র ২৩৩ কোটি টাকা।
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ব্যবসায়ীরাই ঠিক করছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে কারা আসবেন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের লোকজনের যোগসাজশে ঋণ দেয়া হচ্ছে। সে ঋণই এখন খেলাপি হচ্ছে। আর অর্থঋণ ও দেউলিয়া আদালতের মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের কোনো বিচার হচ্ছে না। এ কারণে ঋণখেলাপিরা সাহস পেয়ে গেছেন। ঋণখেলাপিদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার। কারণ ট্রাইব্যুনালে কোনো স্থগিতাদেশ নেই। তাদের জেলে পাঠিয়ে সম্পত্তি জব্দ করলে খেলাপি ঋণ বাড়বে না। মইনুল ইসলাম আরও বলেন, অবলোপন করা ঋণের তথ্য গোপন করে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই ঋণও খেলাপি এবং সুদ আরোপ হচ্ছে। ঋণখেলাপি রাঘববোয়ালদের শাস্তি হলেই খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতের করুণ পরিণতি একদিনে হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নেই। পাশাপাশি বিচারহীনতাও একটি কারণ। গত কয়েক বছরে খাতটিতে খুব বেশি পরিবর্তন বা সংস্কার হয়নি। এসব কারণে দুর্নীতি-অনিয়ম মিলেমিশে গেছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এছাড়া অর্থ পাচারের কারণে খেলাপি ঋণ হু-হু করে বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৯৭ হাজার ১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের ৩৫ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের।
এছাড়া ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা।
সাবেক ব্যাংকার শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ৭২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সে টাকাই এখন ধীরে ধীরে খেলাপি দেখানো হচ্ছে। এছাড়া সর্বত্র এক ধরনের গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ ব্যাংক খাতকে আরও খারাপ করে তুলবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণের বর্তমান চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সরকারি ব্যাংকে পুনর্গঠিত বড় কিছু ঋণ আদায় হয়নি। সে কারণে পরিস্থিতি এত খারাপ দেখা যাচ্ছে। তবে মার্চ মাসে খেলাপি ঋণ একটু বাড়েই। আগামী প্রান্তিকে কিছুটা কমে আসতে পারে। সবাইকে আরও সাবধান হতে হবে।

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/05/18/125418/