১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:০৩

নৌপ্রটোকল চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব

নৌপথে ভারত থেকে পণ্য আসবে ঢাকায়

পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল ‘পোর্ট অব কল’ভুক্ত করার প্রস্তাব * ভিসা ছাড়াই নাবিকরা তিন দিন অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন

নৌপথে ভারত ও ঢাকার মধ্যে সরাসরি পণ্য আনা-নেয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ঢাকায় কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে ওই পণ্য জাহাজ থেকে নামানো ও উঠানো যাবে। এ লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান ‘নৌপথ অতিক্রমণ ও বাণিজ্য প্রটোকল’ (পিআইডব্লিউটিএন্ডটি) চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব করেছে ভারত। এতে বর্তমান রুট সম্প্রসারণ করে এ কনটেইনার টার্মিনালটি ‘পোর্ট অব কল’ভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে ভারত। পাশাপাশি তারা বিদ্যমান চারটি রুটের মধ্যে তিনটিকেই এ বন্দরকে আওতাভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়েছে।


বর্তমানে নৌপ্রটোকল চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের পাঁচটি বন্দর পোর্ট অব কলভুক্ত রয়েছে। এবার ঢাকার একটি পোর্ট এর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এছাড়া ওই প্রস্তাবে নৌপ্রটোকল চুক্তির কিছু ধারায় সংশোধনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। এতে ভিসা ছাড়াই নাবিকদের তিন দিন নির্দিষ্ট বন্দর ও মাটিতে থাকার সুযোগ মিলবে। প্রসঙ্গত, এ চুক্তির আওতায় ১৯৭২ সাল থেকে দুই দেশের নৌপথে পণ্য পরিবাহিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক মাধব রায় যুগান্তরকে বলেন, পানগাঁও বন্দর পর্যন্ত নৌপ্রটোকলের রুট সম্প্রসারণে ভারতের প্রস্তাব পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তারপর নেয়া হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, ভারতের এ প্রস্তাবটি আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি।

নৌমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পানগাঁও টার্মিনাল পোর্ট অব কলভুক্ত করা হলে ভারত থেকে নৌপথে আমদানি করা পণ্য সরাসরি ঢাকায় খালাস করা সম্ভব হবে। ওই পোর্ট থেকে নৌ অথবা সড়কপথে গন্তব্যে যেতে পারবে। একইভাবে ওই বন্দর ব্যবহার করে ঢাকা থেকে সরাসরি ভারতে পণ্য রফতানি করা যাবে। তবে সেক্ষেত্রে পানগাঁও টার্মিনাল পুরোদমে চালু করতে হবে। বাড়াতে হবে বন্দরের অবকাঠামো ও পর্যাপ্ত জনবল সুবিধা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) যৌথভাবে কেরানীগঞ্জে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করে। ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর এ টার্মিনালটি উদ্বোধন করা হয়। সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এ বন্দরটি সচল করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। অবকাঠামো সংকট, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে পর্যাপ্ত সংখ্যক জাহাজ না থাকাসহ নানা কারণে এটি অচল অবস্থায় পড়ে আছে।

জানা গেছে, গত ৯ মে নৌপ্রটোকল চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই প্রস্তাবের অনুলিপি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং নৌপরিবহন অধিদফতরের (ডিজি শিপিং) মহাপরিচালককে দেয়া হয়। এতে প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড চুক্তির ১১ ধারায় সংশোধনী এনে বাংলাদেশের পানগাঁও এবং ভারতের ধুবরি বন্দরকে পোর্ট অব কলভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি করে বন্দর পোর্ট অব কলভুক্ত রয়েছে। নতুন বন্দর যুক্ত হলে পোর্ট অব কলভুক্ত বন্দরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ছয়ে। পানগাঁও ছাড়া বিদ্যমান বাকি পাঁচটি বন্দর হচ্ছে- নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, মংলা, সিরাজগঞ্জ ও আশুগঞ্জ। অপরদিকে ভারতের পোর্ট অব কলভুক্ত পাঁচটি বন্দর হচ্ছে- কলকাতা, হলদিয়া, করিমগঞ্জ, পান্ডু ও শিলঘাট।

প্রস্তাবে আরও দেখা গেছে, পানগাঁও বন্দরকে পোর্ট অব কলভুক্ত করায় নৌরুটেও পরিবর্তন এসেছে। বিদ্যমান চারটি নৌরুটের মধ্যে তিনটিতে পানগাঁও বন্দরে যাতায়াতের পথ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রুটগুলো হচ্ছে- প্রথমত, কলকাতা, হলদিয়া, রায়মঙ্গল, চালনা, খুলনা, মংলা, কাউখালী, বরিশাল, হিজলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, পানগাঁও আরিচা, সিরাজগঞ্জ, বাহাদুরাবাদ, চিলমারী, দুবরি, পান্ডু ও শিলঘাট। দ্বিতীয় নৌপথ হচ্ছে- করিমগঞ্জ, জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর, মারকুলি, আজমিরিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ভৈরব বাজার, নারায়ণগঞ্জ, পানগাঁও, চাঁদপুর, হিজলা, বরিশাল, কাউখালী, মংলা, রায়মঙ্গল, হলদিয়া ও কলকাতা। তৃতীয় রুটটি হচ্ছে- করিমগঞ্জ, জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর, নারায়ণগঞ্জ, মারকুলি, আজমিরিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ভৈরব বাজার, নারায়ণগঞ্জ, পানগাঁও, চাঁদপুর, আরিচা, সিরাজগঞ্জ, বাহাদুরাবাদ, চিলমারী, ধুবরি, পান্ডু ও শিলঘাট। একটি রুটে পানগাঁও বন্দরটি রাখা হয়নি, সেটি হচ্ছে রাজশাহী-গোদাগাড়ি-ধূলিয়ান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ ভারতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও ভারতের নৌসচিব পর্যায়ের বৈঠকে পানগাঁও পর্যন্ত নৌরুট সম্প্রসারণের বিষয়টি সামনে আসে। সে সময় দুই দেশের মধ্যে এ রুট সম্প্রসারণের বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রুট সম্প্রসারণের প্রস্তাব পাঠিয়েছে ভারত।

এদিকে বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, নৌপ্রটোকলের আওতায় ভারত থেকে পণ্য আমদানি হয় বেশি, রফতানি হয় কম। আমদানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিমেন্ট তৈরির উপকরণ ফ্লাইঅ্যাশ ও কয়লা। তবে বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজে পণ্য পরিবহন বেশি হয়। সংস্থাটি জানিয়েছে, নৌপ্রটোকল রুটে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ১০ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৮ টন পণ্য পরিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজে ১০ লাখ ৫১ হাজার ২৬২ টন ও ভারতের মালিকানাধীন জাহাজে ১১ হাজার ৬৩৬ টন পণ্য পরিবহন করা হয়। ওই ছয় মাসে বাংলাদেশি জাহাজ ১ হাজার ৯১টি ট্রিপ দিয়েছে। অপরদিকে ভারতীয় জাহাজ ট্রিপ দিয়েছে ১৩টি।

ভিসা ছাড়াই নাবিকরা তিন দিন অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন : নৌপ্রটোকল চুক্তির ১৫ ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করেছে ভারত। এতে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট বন্দরে জাহাজের নাবিকরা ভিসা ছাড়াই তিন দিনের জন্য অবস্থান করতে পারবেন। এ সময় তারা জাহাজ থেকে মাটিতেও অর্থাৎ জাহাজের বাইরেও যেতে পারবেন। তবে এসব নাবিকের নিজ নিজ দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেয়া সার্টিফিকেট এবং বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে। নৌপরিবহন অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, মানবিক দৃষ্টিতে এটি খুব যৌক্তিক। সাধারণ জাহাজের নাবিকদের দীর্ঘদিন বন্দরে পণ্য লোড-আনলোডের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ভিসা ছাড়াই তিন দিন অবস্থানের সুযোগ পেলে তারা ওই সময়ে নিজ নিজ দেশে ফিরতে পারবেন অথবা নতুন করে ভিসা নিতে পারবেন। তারা আরও জানান, বর্তমানে নাবিকদের জাহাজেই অবস্থান করতে হয়। তারা মাটিতে পা রাখতে পারেন না। এ বিধান যুক্ত হলে তারা জাহাজ থেকে মাটিতেও নামতে পারবেন।

নৌপথ সংরক্ষণে ২০ শতাংশ টাকা দিতে হবে বাংলাদেশকে : নৌপ্রটোকলভুক্ত পথ সংরক্ষণে বাংলাদেশকে বছরে ১০ কোটি টাকা ফি দিয়ে আসছে ভারত। তবে আশুগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথ সংরক্ষণের খরচ ভারতের কাছে চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। প্রস্তাবিত চুক্তিতে ওই খরচের ৮০ শতাংশ দিতে চায় ভারত। বাকি ২০ শতাংশ বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। আর টাকার পরিমাণ নির্ধারিত হবে ওই কাজের টেন্ডারের পাওয়া দর থেকে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/18/125424/