১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৮

ঝিনাইদহে তিন দিনে নিখোঁজ ৯

ঝিনাইদহের চুয়াডাঙ্গা, বারুইখালী ও পোড়াহাটি গ্রামের অন্তত নয় ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে ‘একটি সাদা মাইক্রোবাসে’ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে তাঁদের পরিবার। দুজন বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। অন্য একজন কীভাবে নিখোঁজ হয়েছেন, তাও কেউ জানেন না। 

পুলিশ ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই নয়জন ৪, ৫ ও ৬ মে নিখোঁজ হন। এর মধ্যে ছয়জনকেই ৬ মে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়। কোথাও খোঁজ না পেয়ে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে তাঁদের পরিবারগুলো। তবে পুলিশ বলছে, জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার কারণে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সংস্থা তাঁদের তুলে নিয়ে যেতে পারে।
ঝিনাইদহ শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের গ্রাম চুয়াডাঙ্গা। তার পাশের বারুইখালি ও পোড়াহাটি গ্রাম। গত ২১ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে পোড়াহাটি গ্রামের ধর্মান্তরিত মুসলিম আবদুল্লাহর বাড়ি ঘেরাও করে। এরপর থেকে আলোচনায় আসে গ্রামটি। পরদিন পুলিশ আবদুল্লাহর বাড়িতে অভিযান চালালেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের খবর জানায় পুলিশ। এর ১৪ দিন পর ৭ মে চুয়াডাঙ্গা গ্রাম থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর গ্রামে পুলিশের অভিযানে আবদুল্লাহ ও চুয়াডাঙ্গা গ্রামের তুহিন বিশ্বাস নিহত হন বলে জানায় পুলিশ। আবদুল্লাহ ছিলেন নছিমনচালক আর তুহিন স্থানীয় একটি সার কারখানায় কাঠের গুঁড়ার জোগান দিতেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এঁরা নব্য জেএমবির সদস্য ছিলেন।
নিখোঁজ নয়জন হলেন পুলিশের অভিযানে নিহত তুহিন বিশ্বাসের বড় ভাই মো. টিটু বিশ্বাস (২৫), নিহত আবদুল্লাহর শ্বশুর ভ্যানচালক আবদুল লতিফ, সরকারি কেশব চন্দ্র (কেসি) মহাবিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. শাহীন জামান (২২) ও ডিগ্রি শেষ বর্ষের ছাত্র রানা আহমেদ (২৫), সাইকেল মিস্ত্রি মনোয়ার হোসেন (৩২), গ্রিল মিস্ত্রি লিমন বিশ্বাস (১৭), ইজিবাইক চালক আল আমিন (২৫), কাপড় ব্যবসায়ী মো. সাহেব আলী (৪২) এবং ওয়াজির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ইমন হোসেন (১৭)। এ ছাড়া মহিদুল ইসলাম (২২) নামের এক দরজি সাত দিন নিখোঁজ থাকার পর ১১ মে বাড়ি ফিরে এসেছেন।
ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হরেন্দ্রনাথ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এই নয়জনের মধ্যে কেবল টিটু বিশ্বাসের পরিবার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে। অন্যরা জিডি করতে চান না। জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অন্য কোনো বাহিনী তাঁদের তুলে নিয়ে গেছে কি না, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সেটা হতে পারে, এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, এই নয়জন নিখোঁজ থাকার মধ্যেই গত সোমবার রাতে চুয়াডাঙ্গা গ্রাম থেকে নিহত তুহিন বিশ্বাসের ভাই সেলিম বিশ্বাস ও তাঁর চাচাতো ভাই প্রান্ত বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করেছে র্যা ব। গতকাল বুধবার দুপুর পর্যন্ত তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের বাড়ির আশপাশ থেকে সুইসাইড ভেস্ট, রাসায়নিক দ্রব্য ও বিস্ফোরক জেল উদ্ধার করা হয় বলে র্যা ব জানায়।
নিখোঁজ টিটু বিশ্বাসের বাড়িতে গতকাল গিয়ে কথা বলার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। টিটুর মা শয্যাশায়ী। এক প্রতিবেশী বলেন, টিটু এলাকায় জমি কেনাবেচার মধ্যস্থতা করেন। স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা ও পুলিশের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা ছিল। আরেক প্রতিবেশী দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টিটু যেদিন নিখোঁজ হন, ওই দিন রাত ৮টা পর্যন্ত তিনি বিসিকের গেটের সামনে ছিলেন। একপর্যায়ে তাঁর মুঠোফোনে একটি কল এলে মোটরসাইকেল নিয়ে তিনি শহরের দিকে যান।
টিটুর বাড়ির আধা কিলোমিটার দূরে মো. সাহেব আলীর বাড়ি। ঝিনাইদহ শহরের চান্দা সিনেমা হলের পাশের একটি মার্কেটে তিনি বোরকা বিক্রি করতেন। তাঁর শাশুড়ি মোসা. আমেনা খাতুন বলেন, ৬ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে জনা পাঁচেক লোক সাদা মাইক্রোবাসে করে এসে বলে, ‘আমাদের একজনের বাড়ি দেখিয়ে দিতে হবে’।
সাহেবের বাড়ি থেকে ৪০-৫০ গজ দূরে শাহীনুর জামানের বাড়ি। তাঁর বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা চলছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি একটি কমিউনিটি সেন্টারে ওয়েটারের কাজ করতেন। বাবা আনোয়ার হোসেন মোটরসাইকেল গ্যারেজের মেকানিক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কোনো কিছু না বলেই তাঁর ছেলেকে একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ বলেছে জিডি করতে হবে না। শাহীনুরের বাড়ির কিছুদূরে লিমন বিশ্বাসের বাড়ি। তাঁর মা মোছা. মছিবন নেছা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে বিসিকের একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। সেদিন শুক্রবার হওয়ায় সারা দিন বাড়িতেই ছিল। আসরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি।
পুলিশের অভিযানে নিহত আবদুল্লাহর শ্বশুর মো. আবদুল লতিফ থাকতেন গ্রামের একটি কৃষিখেতের মাঝে বাড়ি বানিয়ে। গতকাল সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। পাশের একটি তিলখেতে কর্মরত চাষি মনসুর মিস্ত্রি বলেন, আবদুল্লাহর বাড়িতে যেদিন পুলিশ অভিযান চালায়, ওই দিন থেকেই লতিফের খোঁজ তাঁরা পাননি।
পোড়াহাটি গ্রামের ইজিবাইক চালক আল আমিন চার ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়। তাঁর স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আল আমিনের মা আয়েশা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করেনি। নিখোঁজ হওয়ার পর কারও কাছে যেতেও পারছেন না। সবাই বলছে, কিছু বলা যাবে না। চুপ করে থাকতে হবে। দিনভর তাই তিনি একা একাই কান্নাকাটি করেন।
আল আমিনের দূরসম্পর্কের আত্মীয় কেসি কলেজের ছাত্র রানা আহমেদও একই দিন নিখোঁজ হন। তাঁর বাড়িতে গেলে চাচি সুফিয়া বেগম বলেন, রানা বুকের ওপর হাত দিয়ে নামাজ পড়ত। এ নিয়ে গ্রামের মুসল্লিরা নাখোশ ছিলেন। কে বা কারা রাতে এসে তাকে নিয়ে গেছে, তা তিনি ঠিকমতো বলতে পারেন না।
নিখোঁজের আট দিনের মাথায় ফিরে আসা মহিদুল ইসলাম কাউকে কিছু বলেননি। তাঁর ভাই মনিরুল ইসলাম বলেন, ৪ মে রাতে বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে যায়। এরপর ১১ মে রাতে ফিরে আসে।
ওয়াজির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র ইমন একটি সবজির দোকানে কাজ করত। তার মা সালমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ১১ দিন আগে সেখান থেকে একটি সাদা মাইক্রোতে করে তাকে নিয়ে যায় কে বা কারা।
চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আধা কিলোমিটারের কম দূরত্বে র্যা ব-৬-এর ঝিনাইদহ ক্যাম্প। জানতে চাইলে ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মনির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরা আমাদের নলেজে নাই। তারা যদি জঙ্গি-সম্পৃক্ত হয়, সে ক্ষেত্রে তারা গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে।’
র্যা বের অভিযান সমাপ্ত
চুয়াডাঙ্গা গ্রামে র্যা বের জঙ্গিবিরোধী দুই দিনের অভিযান গতকাল শেষ হয়েছে। এই অভিযানে আটক সেলিম ও প্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন র্যা ব কর্মকর্তারা। অভিযান শেষে দুপুরে ঝিনাইদহ ক্যাম্পে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, আটক সেলিম হোসেন (৪০) ও প্রান্ত বিশ্বাস (১৭) সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সদস্য। ২০১৪ সাল থেকে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার সকাল থেকে চুয়াডাঙ্গা গ্রামে অভিযান চালানো হয়।
মুফতি মাহমুদ বলেন, প্রান্ত র্যা বকে বলেছে, বজরাপুরে নিহত তুহিন গত ২০ এপ্রিল দুটি সুইসাইড ভেস্ট এনে তাকে দেন। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তার (প্রান্ত) কাছে রাখতে বলেন। প্রান্ত ও সেলিম জিজ্ঞাসাবাদে লিমন নামের এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেছেন, লিমন এই এলাকায় তাঁদের সংগঠিত করছেন।
পুলিশ তাদের অভিযানে নিহত আবদুল্লাহ ও তুহিনকে নব্য জেএমবির সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছে। তাহলে তাঁদের সঙ্গেই যোগাযোগ থাকা সেলিম ও প্রান্ত কীভাবে সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সদস্য হন—এ প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ বলেন, বিষয়গুলো আগেই স্পষ্ট করা হয়েছে।
ঝিনাইদহ ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর মনির আহম্মেদ বলেন, র্যা বের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের সদস্যরা জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা দুটি সুইসাইড ভেস্ট ও একটি অ্যান্টি মাইন নিষ্ক্রিয় করেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1184506/