১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৪

ত্রাণের জন্য অপেক্ষা

জেলার হাকালুকি, কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর। আর মনু, ধলাই, সুনাই ও জুড়ী নদী। একই অবস্থা জেলার হাওর ও নদী তীরবর্তী কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষের। এ বছর বোরো ধান, মাছ আর মৌসুমী সবজির ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত। আগাম বন্যার প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছাড়া এখনো মিলছে না পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা। তাই সরকারি বেসরকারি সহায়তার প্রত্যাশায় এখন প্রতীক্ষায় হাওর তীরের অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। এবছর চৈত্রের অকাল বন্যায় সব হারিয়ে চরম অসহায় এ জেলার হাওর আর নদীতীরের মানুষ। ধান নেই, মাছও নেই। পানি দূষিত হয়ে মরেছে জলজ প্রাণী আর পোষা হাঁসও। খাদ্য আর বাসস্থান সঙ্কটে বিক্রি করেছেন গৃহপালিত পশুও। একে একে বেঁচে থাকার সব উপকরণ এখন হাতছাড়া হওয়ায় তারা হতাশ। তাই এবছর

পরিবার-পরিজন নিয়ে খাওয়া বাঁচার চিন্তায় চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় হাওর পাড়ের বাসিন্দারা। এবছর তাদের এমন বিড়ম্বনায় ফেলেছে এই হাওর ও নদী। হঠাৎ রাক্ষুসে হয়ে হাওর ও নদী গিলে খেয়েছে তাদের জীবন জীবিকা চলার সব সম্পদ। এটা তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনা হলেও কম দায়ী নয় সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা। প্রতিবছরই হাওর থেকে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় হলেও এর উন্নয়নে নেননি কোন মহাপরিকল্পনা। এমনকি দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি হাওর উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায়ও স্থান পায়নি। দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না হওয়ায় স্থানীয় এই নদী ও হাওরে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় বর্ষায় বন্যা আর শুষ্ক মৌসুমে ধূ ধূ মরুভূমি। ক্ষতিগ্রস্তরা জানালেন নাব্য হ্রাসে এখন প্রতিবছরই স্থানীয় হাওর ও নদী তাদের প্রতি এমন নির্দয় হলেও এ বছর ঘটেছে চূড়ান্ত বির্পযয়। অনান্য বছর হাওর ও নদী পাড়ের চাষিরা অধিকাংশ বোরো ধান আর রবিশস্য ঘরে তুললেও এ বছর ঘটেছে ব্যত্যয়। হঠাৎ ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢল তলিয়ে দিলো তাদের বছরজুড়ে খাওয়া-বাঁচার একমাত্র স্বপ্নের সোনালি ফসল বোরো ধান। এমন বির্পযয় এর আগে কখনো দেখেনি এ অঞ্চলের হাওর এলাকার মানুষ। সব হারিয়ে এমন দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন দিশাহারা হাওর তীরের বাসিন্দারা। জানা যায় হাওর তীরের লোকজনের জীবন-জীবিকা একমাত্র ফসল বোরো ধানকে ঘিরে। বোরো ধান ঘওে তোলা শেষ হলে তারা হাওরের মাছ ধরে খরচ যোগায় সংসারের। কিন্তু এবছর তাদের চোখের সামনেই সবই বিলীন হলো আগাম বন্যার পানিতে। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায় জেলায় অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। বর্ষা মৌসুমের সবজির ফসলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০১ হেক্টর। টাকার মূল্যে এই ক্ষতির পরিমাণ ২৭-২৮ কোটি টাকা। বোরো ফসলের ক্ষতি ১৭ হাজার ৪শ’ ৩২ হেক্টর। যা টাকার মূল্যে (৩২ টাকা চালের দর হিসেবে) ১শ’ ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা । ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার কৃষক। জলজ প্রাণীর ক্ষতি প্রায় ২৮ কোটি টাকা। শুধু হাকালুকি হাওরে মারা গেছে ২৫ হাজার মেট্রিকটন মাছ। তবে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চূড়ান্ত করতে সংশ্লিষ্টদের চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ আর পরিমাণের হালনাগাদ। সরকারি সহায়তা হিসেবে এ পর্যন্ত জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোতে তৃতীয় দফা ত্রাণ সহায়তা দিলেও তা ছিলো একেবারেই অপ্রতুল। এই তিন দফা ত্রাণ সহায়তার মধ্যে ছিলো চাল ও নগদ টাকা। জানা যায় জেলার ৪ লাখ ক্ষতিগ্রস্তের জন্য বরাদ্দ ছিলো ১ হাজার ভিজিএফ কার্ড ও নগদ ৫০০ টাকা। ক্ষতিগস্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা জানান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এ যাবত যে সরকারি সহায়তা এসেছে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। হাওর তীরের কম সংখ্যক মানুষ এই সহায়তা পেলে বেশি সংখ্যক লোকজন এই ত্রাণ সহায়তা থেকে হয়েছেন বঞ্চিত। এখন চলছে ওএমএস’র চালের মাধ্যমে সরকারি সহায়তা। ন্যায্যমূল্যের নির্দিষ্ট দোকানে প্রত্যেক ক্ষতিগস্ত পরিবার ১৫ টাকা দরে প্রতিদিন পাচ্ছেন ৫ কেজি ওএমএস’র চাল। একজন ডিলার প্রতিদিন ২০০ জনের কাছে এই চাল বিক্রি করতে পারবেন। এ সহায়তা চলবে একমাস। জানা যায়, হাকালুকি হাওরের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় মোট ১৪ জন ডিলারের মাধ্যমে ওএমএস’র চাল বিক্রির কার্যক্রম চললেও তা ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। প্রতিদিন ২ হাজার ৮শ’ লোক এই সহায়তা পেলেও লাইনে দাঁড়িয়ে চাল না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন প্রায় ৬-৭ হাজার মানুষ। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা বাড়ানোর চাহিদার বিষয়টি তারা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। তবে এখনো আসেনি চাহিদার সেই ত্রাণ সহায়তা। হাওরপাড়ের ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, তারা সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থারই ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না বললেই চলে। কারণ এ পর্যন্ত আসা সরকারি সহায়তাগুলো তাদের এলাকার কম সংখ্যক লোক পেলেও অধিকাংশই পাননি এই সহায়তা। তারা জানালেন ২০১০ সালের দিকে বন্যা হলে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া সংগঠন, ধনাঢ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেও এ বছর এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া নেই ত্রাণের। অথচ এমন ভয়াবহ বিপর্যয় এর আগে কখনো মোকাবেলা করতে হয়নি এ অঞ্চলের হাওর ও নদীতীরের কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষের। গতকাল সরজমিন হাওর ও নদী তীরবর্তী এলাকায় গেলে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রাণের জন্য এমন মানবিক আবেদন জানান। হাকালুকি হাওর পাড়ের বাসিন্দা বৃদ্ধ তৈইমুছ আলী (৬৫), ছানা মিয়া (৭০), আয়ছর আলী (৫৮), লিচু মিয়া (৬০), গুলজার মিয়া (৭০) বলেন, সরকারের পাশাপাশি যদি অন্যান্যরা ত্রাণ সহায়তা না নিয়ে আসেন তা হলে আমাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। আমরা কখনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তার অপেক্ষায় থাকি না। আমরা সবসময়ই আমাদের পরিশ্রমের আয় উপার্জন দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে খেতে চাই। কিন্তু এ বছর প্রকৃতি আমাদের উপর সহায় না হওয়ায় আমাদের সারা বছরের খাওয়া বাঁচার অন্যতম উৎস বোরো ফসল তলিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের দুর্দিন যাচ্ছে। এ সময় আমাদের পাশে দাঁড়ালে আমরা বেঁচে থাকার মনোবল পাবো। তাই সকল বৃত্তবানের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন আমাদের প্রতি আপনারা সাহায্যের হাত বাড়ান। গতকাল অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার হাওর ও নদী তীরের দুর্গত অসহায় মানুষের সুখ দুঃখের খবর নিতে গেলে সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে তারা জানতে চান ভাই ওরা কই (কোথায়)? ওরা আসছেন না কেন? আমাদের দুঃখের কথা তাদের জানান। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যাশা আমাদের এমন দুঃখ-দুর্দশার কথা জানলে অন্যবারের মতো এবারও তারা আমাদের পাশে (ত্রাণ সহায়তা নিয়ে) এসে দাঁড়াবেন। তবে একেবারেই যে বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছেন না- এমনটি নয়। সম্প্রতি ঢাকাস্থ মৌলভীবাজার সমিতি, মৌলভীবাজার একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তানভীর’স এন্টারপ্রাইজ ও ছাত্র ইউনিয়ন মৌলভীবাজার জেলা শাখা হাকালুকি হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণ করেছেন বলে স্থানীয় বাসিন্তারা জানিয়েছেন। তবে তা ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় অপ্রতুল। তাই ওদের দুর্দিনে সকলের সম্মিলিত সহযোগিতার প্রয়োজন বলে জোর দাবি স্থানীয় সচেতন মহলের।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=65814&cat=6/