৬ মে ২০১৭, শনিবার, ১০:১৭

অভ্যন্তরীণ স্থবিরতা কাটাতে বিদেশে বিনিয়োগে আইন

দেশে বিনিয়োগের স্থবিরতা না কাটলেও এবার ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে আইন প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এতে মুদ্রা পাচারের ঝুঁকি থাকলেও গতি আসতে পারে বিনিয়োগে। তৃতীয় বিশে^র এলডিসি সুবিধা কাজে লাগিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে বাংলাদেশ। বিদেশে বিনিয়োগে প্রয়োজন আইন ও নীতিমালা।

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, দেশের বিনিয়োগে অনেক বাধা রয়েছে। এখানে ব্যাংক ঋণ পেতে হলে নানা ঝামেলা অতিক্রম করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ পেতে হলে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। রয়েছে গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংযোগ পেতে নানা ঝামেলা। এসব ঝামেলা অতিক্রম করে বিনিয়োগ করতে অে কে সাহস পাচ্ছে না। এছাড়াও এখানে বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনৈতিক অস্তিরতা। প্রকৃত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে এখানে বিনিয়োগ নিরাপদ মনে করছে না ব্যবসায়ীরা। আর এ কারণেই দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি পাচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বিদেশে বিনিয়োগে অর্থনীতিবিদরা বিরোধিতা করলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর কারণেই বিডা আইন প্রণয়নের প্রত্রিয়া চালাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পেলে দেশে বিনিয়োগে আস্থা বাড়বে। তবে আইন প্রণয়নে ধীরে চলো নীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
ব্যবসায়ীদের বিদেশে বৈধ বিনিয়োগের আকাঙ্খা দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে বাধা সুর্নিদিষ্ট নীতিমালার অভাব। যদিও রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটায় কিছু প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান, ইথিওপিয়াসহ বেশকিছু দেশে সীমিত বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। যারাই বিদেশে বিনিয়োগ করেছে তারা সবাই ভাল রয়েছে।
এফবিসিসিআই’র সভাপতি মাতলুব আহমাদ বলেন, ব্যবসায় আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা তৃতীয় বিশে^র যেকোন দেশে বিনিয়োগ করলে ভাল করবো। এজন্য দরকার সরকারের আইনি সহায়তা। সরকার সহায়তা করলো আমরা অবশ্যই ভাল করবো।
তিনি আরও বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান কৃষি, পোশাক ও আর্থিক খাতে কেনিয়া, গাম্বিয়াসহ কিছু দেশে বিনিয়োগের অনুমতি চেয়েছে। এজন্য উদার নীতিমালা চান ব্যবসায়ীরা।
বিদেশে বিনিয়োগের নীতিমালার তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বেড়েছে তৎপরতা। তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিনিয়োগ করে এলডিসি সুবিধা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে অধিক মুনাফা করতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিডা।
বিডার সদস্য তৌহিদুর রহমান খান বলেন, অনুমতি দেয়ার আগে পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। বিদেশে পাঠানো অর্থ ভিন্ন খাতে যাচ্ছে কিনা মুনাফা দেশে আসবে কিনা, বিনিয়োগের টাকা ফেরত আসবে কি না এসব বিষয় বিবেচনার পরামর্শ দেন তিনি।
পিআরআই নির্বাহী আহসান এইচ মনসুর বলেন,বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি পেলে বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটতে পারে। তবে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিলে স্থানীয় বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্থ হবে কিনা তাও ভেবে দেখার দরকার। তিনি বলেন আমাদের দেশে এমনিতেই পাচারের পরি মান অনেক বেশি। বিদেশের বিনিয়োগের নামে যাতে নতুন করে কোন টাকা পাচার না হয় তা অবশ্যই মনিটরিং বাড়াতে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি মনে করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির এক তরফা নির্বাচনের পর রাজনীতিতিকদের সাথে সাথে ব্যবসায়ীরাও আস্থাহীনতায় ভোগছেন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অজানা শঙ্কা সব সময় তারা করে ফিরছে দেশিয় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োকারিদের। সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে মুলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে যারা বড় ধরনের বিনিয়োগকারি যাদের ব্যাপারে সরকারে ইতিবাচক ধারনা রয়েছে। যারা মুনাফা দেখাতে পারে তাদের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তবে ঢালাও ভাবে অনুমতি দেয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারি শেষে তা অর্জিত হয়েছে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এবারও বেসরকারি খাতের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। আর এ কারনেই বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। সরকার মনে করছে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি না দেয়ার কারনেই মুদ্রা পাচার বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছরের জুনে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে এসে তা নেমে আসে ১৫ দশমিক ৫৫ শতাংশে। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি অনুযায়ী বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন না হওয়ায় আগামী জুনের জন্য মুদ্রানীতিতে তা লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাড়ে ১৬ শতাংশ করা হয়। কিন্তু জানুয়ারিতে তা কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। এটা স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি নয় বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অনেক উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। মূলধনি যন্ত্রপাতিও আমদানি করে শিল্প স্থাপন করেছেন। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় তারা চালু করতে পারছে না। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা না পাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য তহবিলও বেড়েছে।
এক দিকে ঋণ দেয়ার মতো নতুন উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না, পাশাপাশি সরকার ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করায় ব্যাংকগুলোর অলস অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। আর একারনেই টাকা পাচার বেড়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে এখন আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। আমানতের সুদহার কমতে কমতে এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, এক দিকে সরকার ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে, অপর দিকে ভালো উদ্যোক্তা না পাওয়ায় তাদের বিনিয়োগযোগ্য তহবিল বেড়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো এখন বিকল্প দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অর্থাৎ অনেকেই এখন ভোক্তাঋণসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করছে। এসব ঋণ জামানতবিহীন হওয়ায় ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বিকল্প খাতে ঋণ দেয়ায় ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ সামান্য বেড়েছে। তবে এটা স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি নয়। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। তা না হলে এবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।

http://www.dailysangram.com/post/282588-