৬ মে ২০১৭, শনিবার, ১০:১৬

বন্ধ্যাদের সন্তান লাভের নামে ভয়াবহ প্রতারণা

দম্পতিরা জানতেও পারছেন না সন্তানের নামে তারা কার উত্তরাধিকারী আনছেন

বন্ধ্যা দম্পতিদের চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে একটি প্রতারক চক্র শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সন্তান লাভের আশায় এসব দম্পতি দেশের বাইরে গিয়েও প্রতারিত হচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠান মেলার নামে হাজার হাজার মানুষকে একত্রিত করে লোভনীয় অফার দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরা প্রতিবেশী দেশে স্বল্প খরচে বন্ধ্যা নারীদের সন্তান লাভে প্রলোভন দেখাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে বন্ধ্যা রোগীর চিকিৎসা মেলা বসানো হয়েছে। সেখানে প্রতিবেশী দেশটির এ রকম কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। প্রতারণাই এদের উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন এ দেশের চিকিৎসকেরা।
বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে যে মেলাটি হচ্ছে এর অনুমোদন নেয়া হয়েছে কি না তা বলতে পারেননি বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তবে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা: মো: জাহেদুল হক বসুনিয়াকে পাওয়া যায়নি মন্তব্য করার জন্য।
জানা গেছে, বন্ধ্যা দম্পতিদের সন্তান ধারণে তাদের অজান্তে ওই চক্রটি অনৈতিক পন্থাও ব্যবহার করছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান এদেশীয় এজেন্টদের সহায়তায় বন্ধ্যা দম্পতিদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। সহজ-সরল দম্পতিরা জানতেও পারছে না সন্তানের নামে তারা যা নিয়ে আসছেন তা আসলে তার রক্তের উত্তরাধিকারী কি না। অভিযোগ রয়েছে অন্যের স্পার্ম অথবা ডিমের মাধ্যমে বন্ধ্যা দম্পতিদের গর্ভ ধারণে সহায়তা করছে এরা। ‘একজন বন্ধ্যা পুরুষও সুখী বাবা হতে পারেন অথবা টিউব ব্লক থাকলেও গর্ভধারণ করা সম্ভব’ বলে চটকদার বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে এ দেশের সহজ-সরল মানুষকে প্রতারিত করছে।
চিকিৎসকেরা জানান, বাংলাদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ দম্পতি নানা কারণে সন্তান ধারণ করতে পারছেন না। এদের সবাই যে একেবারে বন্ধ্যা, তা নয়। সামান্য চিকিৎসা করালেই অনেক দম্পতির সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের ওই চক্রটি সহজ-সরল দম্পতিদের নানা কিছু বুঝিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে এবং অকারণে পকেট কাটছে। বাংলাদেশ থেকে ঠিক কত সংখ্যক বন্ধ্যা দম্পতি ওই দেশে যায় এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এ সংখ্যাটি বছরে পাঁচ হাজারের কম নয়। পাঁচ হাজার ধরে নিলে দম্পতি প্রতি দুই লাখ টাকা নিলেও ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে বলে জানান একজন চিকিৎসক। জানা গেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান ১০ লাখ টাকাও নিয়ে থাকে। এ রকম হলে টাকার অঙ্কটি ৫০০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছায়।
ঢাকার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি ভারতের মাদ্রাজে গিয়েছিলেন সন্তান ধারণে সহায়তা করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে যেতেই ওই প্রতিষ্ঠানের লোকজন তার উদ্দেশ্য জানতে পেরে তাকে অথবা তার স্ত্রীকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই নির্দেশ দিলেন টাকা জমা দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক ‘কার সমস্যা, আমার না আমার স্ত্রীর অথবা আমাদের দুইজনের কী সমস্যা আছে তা নিশ্চিত না হয়ে কিভাবে আপনারা সহায়তা করবেন’ জানতে চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের লোকজন তাকে জানালেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না। দুইজনেরই সমস্যা থাকলেও আমাদের কাছে এর সমাধান রয়েছে। তারা বললেন, তারা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক পরে জানতে পারেন যে, যেসব দম্পতির দু’জনই সমস্যায় ভুগছেন তাদের অন্যের ডিম ও শুক্রাণু দিয়ে সন্তান নিতে সহায়তা করে ওই প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, প্রতিবেশী ওই দেশটির লোকজন হয়তো এতে কোনো সমস্যা নাও দেখতে পারেন কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমি তা কিছুতেই গ্রহণ করতে পারি না। তিনি জানান, ওরা যা করে থাকে এর পুরোটাই অনৈতিক ও বেআইনি। প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অনুমোদিত নয়। আমাদের দেশে কোনো পক্ষই এটিকে অনুমোদন দেয় না।
এ্যাপোলো হাসপাতালের অধ্যাপক ডা: মৃণাল কুমার সরকার বলেন, বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জাল বিছিয়েছে। স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে এরা এখানে সেমিনার করে বন্ধ্যা দম্পতিদের প্রতারিত করছে। তিনি বলেন, বন্ধ্যা দম্পতিদের যেভাবে এরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি তা প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। বন্ধ্যা দম্পতিদের সন্তান ধারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ব্রিটেনে, সিঙ্গাপুরে ২০১৫ সালে সফলতার হার ছিল ৩১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ৪০.৮ শতাংশ। কী এমন হয়ে গেল যে প্রতিবেশী দেশটিতে বন্ধ্যা দম্পতিদের সন্তান ধারণ পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটে গেছে? এরা বলছে তাদের সফলতার হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। আমেরিকার মতো উন্নত রাষ্ট্রে যেখানে ৩১ শতাংশ সেখানে প্রতিবেশী দেশে কী করে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সফলতা দাবি করতে পারে? সফলতার হার এত বেশি থাকলে তো এরা নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেত।
এ ব্যাপারে ঢাকার মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের ইনফাটিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক ডা: রাশিদা বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফের সফলতার হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে আমরা সামান্য পিছিয়ে আছি। তবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের সফলতার হার ধীরে ধীরে বাড়ছে। তিনি বলেন, ইথিক্যাল প্র্যাকটিস করলে এর চেয়ে বেশি হওয়া সম্ভব নয়।
ঢাকার একজন সিনিয়র এমব্রায়োলজিস্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অন্যের স্পার্ম অথবা ডিম নিয়ে সন্তান ধারণে সহায়তা করা পুরোপুরি অনৈতিক। গর্ভধারণের সময় হয়তো আবেগের কারণে এ বিষয়টি দম্পতিদের মাথায় থাকে না। পরে সন্তান বড় হলে সে নিজেই খোঁজে তার বায়োলজিক্যাল বাবা অথবা মা কে? এটি নিয়ে সাংসারিক ঝামেলায় পড়েন থাকেন দম্পতিরা। ইতালিতে এ ধরনের অনৈতিক কাজকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর বাংলাদেশের মতো সমাজে তো এটি গ্রহণীয় হতেই পারে না।
বাংলাদেশে বন্ধ্যা দম্পতিদের গর্ভধারণে সহায়তা করে এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০টির মতো। এ সেন্টারগুলো বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার দম্পতি পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য অনুসারে বন্ধ্যা দম্পতিদের ৫ শতাংশের কম ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু এদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ সফল হন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/217707