৩ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:০০

উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের ৩৮ জেলায় বিদ্যুতের মহাবিপর্যয়

বিদ্যুতের দুইটি জাতীয় সঞ্চালন লাইন বিকল হয়ে যাওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার এতে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩৮টি জেলায় বিদ্যুতের মহাবিপর্যয় ঘটেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ শূন্য ছিল এসব জেলা। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বিশেষ করে হাসপাতালে রোগীদের পড়তে হয় চরম সংকটে। হিমায়িত পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়ে ক্রেতারা। ঝড়ের কারণে এমন বিপর্যয় ঘটেছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানা গেছে। তবে ঘটনা অনুসন্ধানে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পিজিসিবি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টা ২০ মিনিটে টর্নেডোতে ঈশ্বরদী ঘোড়াশাল ২৩০ কেভি জাতীয় গ্রিড বিকল হয়ে পড়ে। আর সোমবার ঝড়ে আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি জাতীয় গ্রিড বিকল হয়। এই দুই গ্রিড বিকল হওয়ায় দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়।

পিডিবি সূত্র জানায়, সঞ্চালন লাইন বন্ধ থাকায় অনেক স্থানেই গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়নি। এছাড়া ময়মনসিংহ থেকে ত্রিশাল, ভৈরব থেকে দুলিয়ারচর, সুনামগঞ্জ থেকে ধীরা ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন বন্ধ আছে।
পিডিবির হিসাবে খুলনা বরিশাল রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে দুই হাজার ৬৬৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৩৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। সোমবার এসব কেন্দ্র থেকে এক হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে এর বেশিরভাগই বন্ধ ছিল। পর্যায়ক্রমে এগুলো উৎপানে আনা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মামুনুর রশীদ জানান, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যমুনা সেতু হয়ে যে বিদ্যুতের লাইনটি এসে পুরো উত্তরবঙ্গ তথা রাজশাহী-রংপুর জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তা ঝড়ের কারণে বন্ধ হয়ে যায় সোমবার। পরে আরিচা হয়ে যে লাইনটি আসে টঙ্গীতে বিপর্যয় ঘটলে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গে বিদ্যুৎ আসার সব রাস্তা বন্ধ হয়। সকাল থেকেই বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায় ঠাকুরগাঁওসহ সমগ্র রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে।’
বিদ্যুৎ কতক্ষণ বন্ধ থাকতে পারে সে প্রশ্নে মামুনুর রশিদ জানান, ‘জট খুলতে শুরু করেছে। কিছু কিছু জেলায় বিদ্যুৎ এসেছে। বাকি জেলাগুলোতেও আসতে শুরু করবে।’
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এমডি সাজ্জাদুর রহমান জানান, সোমবার রাতে কালবৈশাখী ঝড়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের কালীপুরে একটি বিদ্যুতের টাওয়ার ভেঙে যায়। এর ফলে ২৩০ কিলোভোল্টের সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হাই ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের মধ্যে পড়ে।

তিনি জানান, ওই লাইন মেরামত করার সময় মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইন ‘ট্রিপ’ করলে এর সঙ্গে যুক্ত রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চল বিদ্যুৎ হীন হয়ে পড়ে। ওই দুই জোনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে খুলনা ও বরিশাল জোনেও সরবরাহ ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের সহকারী ম্যানেজার (জনসংযোগ) এ বিএম বদরুদ্দোজা খান জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর জোনে বিদ্যুৎ সরবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করছি বিকালের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

এদিকে সঞ্চালন লাইনে সমস্যা দেখা দেয়ায় দেশের অর্ধেক জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এ প্রতিষ্ঠানের সহকারী ম্যানেজার (জনসংযোগ) এ বিএম বদরুদ্দোজা খান জানান, তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য পাঁচ দিন সময় দেয়া হয়েছে। পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী (ট্রান্সিমিশন-২) মো. কামরুল হাসান এ তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেবেন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২ হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার মোট ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া আন্তঃদেশীয় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে। পিজিসিবির ওই চার জোনে মোট ৩২টি জেলা রয়েছে, যেখানে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বসবাস।
এর বাইরে ঢাকা জোনের জেলা ফরিদপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার খবর জানা গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু করতেও কিছুটা বিদ্যুৎ লাগে। আবার কোনো কারণে কোনো সঞ্চালন লাইনে লোড বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
কোনো কারণে কোনো কেন্দ্র বা সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো সিস্টেমে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কিছু এলাকা বিদ্যুৎহীন রেখে অথবা অন্য কোনো গ্রিডে থেকে বিদ্যুৎ এনে ‘লোড’ সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা করা না গেলে অর্থাৎ লোড সমন্বয় না হলে অন্য কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ বাড়ে।
এভাবে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর নতুন করে কোনো কেন্দ্র বন্ধ হলে সরবরাহে ঘাটতি আরও বাড়ে এবং একইভাবে অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রও বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
সিরাজগঞ্জ পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলী (বিতরণ) আলমগীর মাহফুজুর রহমান জানান, তার এলাকায় ১১টা ৫৫ মিনিটে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বেলা পৌনে ৩টার দিকে বিদ্যুৎ এলেও সরবরাহ কম থাকায় বিকাল ৫টা পর্যন্ত অনেক এলাকায় লোড শেডিং চলছিল।
পিজিসিবি ঝিনাইদাহ সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী উত্তম কুমার সাধু জানান, পদ্মার পশ্চিম পাশের সবগুলো জেলার মানুষকেই বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়তে হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় পিজিসিবির বটতৈল স্টেশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু তালেব জানান, বেলা ১১টা ২৪ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর ১২টা ৩ মিনিটে আসে। কিন্তু পৌনে ১টার দিকে আবারও চলে যায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা ওই পরিস্থিতি চলে। একই রকম পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন পাবনা, খুলনা ও যশোরের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
ওজোপাডিকোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, বরিশালে সাড়ে ১১টার দিকে ট্রিপ করে। এর কিছুক্ষণ পরে ভোলা থেকে ২২-২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাও বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর দেড়টার পর থেকে জাতীয় গ্রিড থেকে পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ায় তা দিয়ে সাবস্টেশনগুলো সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। পরে ধীরে ধীরে সরবরাহ বাড়তে থাকে।
এর আগে ২০১৪ সালের ১ নবেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সঞ্চালন কেন্দ্রে বির্পযয় দেখা দিলে ভারতের সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভারতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রক্রিয়া।

http://www.dailysangram.com/post/282195