৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৬

বিদ্যুৎবিহীন ৩২ জেলা ভোগান্তি সারা দেশে

গ্রিড বিপর্যয়

ঝড়ে আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বিকল হয়ে যায় গত সোমবার রাতে। বিকল লাইন মেরামতের মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইনে দেখা দেয় বিপর্যয়। দেশের দু’টি সঞ্চালন লাইন বিকল হয়ে যাওয়ায় এ দুই লাইনের আওতাধীন প্রায় ৩২টি জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল বেলা ১১টা থেকে শুরু হয়ে কোনো কোনো এলাকায় সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত একটানা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের এ প্রভাব প্রায় সারা দেশেই পড়ে। অন্য জেলাগুলোতেও ঘন ঘন লোডশেডিং হয়। বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালে রোগীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। শিল্পকারখানার চাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন বন্ধ রেখে অলস সময় কাটান শ্রমিকেরা। রেফ্রিজারেটরে থাকা গোশত, মাছসহ খাদ্যসামগ্রী নষ্ট হয়ে যায়। পানির পাম্প চালাতে না পেরে পানির সঙ্কটে পড়ে মানুষ। গ্রীষ্মের খরতাপের সময় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে চরমমূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সঞ্চালন কেন্দ্রে বির্পযয় দেখা দিলে ভারতের সাথে সঞ্চালন লাইন বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভারতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রক্রিয়া।
পাওয়া গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় নয়া দিগন্তকে জানান, বিকল হওয়া সঞ্চালন লাইন দ্রুত মেরামত করা হয়েছে। ফলে বেলা ৩টা থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে তিনি দাবি করেন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল হাসান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, প্রথমে রাতে ঝড়ের কারণে সিরাজগঞ্জ-আশুগঞ্জ সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ লাইন মেরামতের মধ্যেই গতকাল বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইনে বিপর্যয় দেখা দেয়। ফলে একে একে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে। তবে দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে। শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
যে কারণে গ্রিড বিপর্যয় : বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমবার রাতে ঝড়ে আশুগঞ্জ থেকে সিরাজগঞ্জ লাইনের টাওয়ার তিগ্রস্ত হওয়ায় ঘোড়াশাল থেকে ঈশ্বরদী লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইনে গতকাল বিদ্যুৎ সরবরাহে বিভ্রাট দেখা দেয়। ফলে পিজিসিবির রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং তাতে সেসব এলাকার সব বিদ্যুৎকেন্দ্রেও উৎপাদন থেমে যায়। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দুই হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট উৎপাদন মতার ২৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া আন্ত:দেশীয় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে। পিজিসিবির ওই চার অঞ্চলে ৩২টি জেলা রয়েছে, যেখানে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বসবাস।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে সোমবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালীপুরে বিদ্যুতের একটি টাওয়ার ভেঙে পড়ে ২৩০ কিলোভোল্টের সরবরাহ লাইন তিগ্রস্ত হয়। ২৩০ কেভি লাইন হাইভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের মধ্যে পড়ে। সারা দেশে পিজিসিবির তিন হাজার ১৮৫ সার্কিট কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন রয়েছে। আশুগঞ্জের ওই লাইন মেরামত করার মধ্যেই মঙ্গলবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইন ‘ট্রিপ’ করলে দেশের পশ্চিম ও দণি অংশের জেলাগুলো বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।


তারা জানান, কোনো বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বা বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো সিস্টেমে সরবরাহের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কিছু এলাকা বিদ্যুৎহীন রেখে অথবা অন্য কোনো গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ এনে ‘লোড’ সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা করা না গেলে অর্থাৎ লোড সমন্বয় না হলে অন্য কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ বাড়ে। এভাবে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর নতুন করে কোনো কেন্দ্র বন্ধ হলে সরবরাহে ঘাটতি আরো বাড়ে এবং একইভাবে অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এ দিকে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় উত্তর-পশ্চিম ও দণি অঞ্চলের জেলাগুলোর বাসিন্দাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে খবর দিয়েছেন আমাদের জেলা সংবাদদাতারা। গাইবান্ধা জেলা সংবাদদাতা জানান, বেলা সাড়ে ১১টায় গাইবান্ধাসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ চলে যায়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ( সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা) গাইবান্ধা জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। তবে গাইবান্ধা জেলা বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম আমাদের গাইবান্ধা জেলা সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন, জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা মাত্রই গাইবান্ধা জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। তিনি জানান, দক্ষিণ অঞ্চল থেকে উত্তর অঞ্চল গ্রিডে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তা বিকল হয়ে যাওয়ায় গতকাল বেলা ১১টায় গাইবান্ধাসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসেনি। কখন আসবে সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। এ দিকে বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়ে গোটা জনগণ। বিশেষ করে হাসপাতাল, কিনিকের অপারেশন থিয়েটার বন্ধ থাকে। মুমূর্ষু রোগীরা পড়েন বিপাকে। বিদ্যুৎ না থাকায় কলকারখানার চাকা বন্ধ থাকে। ফলে সারা দিন শ্রমিকেরা অলস সময় কাটায়। বিদ্যুৎ না থাকায় পানির পাম্পগুলো চালু করা যায়নি। ফলে পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। ফ্রিজে থাকা গোশত, মাছ, তরিতরকারিসহ পণ্যসামগ্রী নষ্ট হয়ে যায়। সবমিলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন এ অঞ্চলের মানুষ।
গাইবান্ধার মতো, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, বরিশাল, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকার সংবাদদাতারা একই দুর্ভোগের কথা জানিযেছেন। আমাদের সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ জেলায় বিদ্যুৎ ছিল না। ৩টার পর ১০ মিনিট বিদ্যুৎ আসে। ফলে বিদ্যুৎ না থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েন এ এলাকার মানুষ।
এ দিকে ৩২ জেলার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের প্রভাব অন্য জেলাগুলোতেও পড়ে। আমাদের রাজশাহী সংবাদদাতা জানান, গতকাল দফায় দফায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে। রাজধানী ঢাকাতেও কয়েক দফা লোডশেডিং হয়েছে। দেশের অন্য জেলাগুলোতেও লোডশেডিংয়ের খবর দিয়েছেন আমাদের জেলা সংবাদদাতারা। ভ্যাপসা গরমের সময়, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় মানুষকে। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে গোটা দেশবাসীকেই মূল্য দিতে হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/216953