৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৪

দাদনের ফাঁদে ইটভাটার লক্ষাধিক শ্রমিক

বাঁশের তৈরি এমন ছোট্ট ঘরে বসবাস ইটভাটার শ্রমিকদেরবুড়িগঙ্গার তীরে বাঁশের তৈরি ছোট্ট ছোট্ট ঘর। দৈর্ঘ্য ১০ ফুট, প্রস্থ ৫। এর ভেতরে দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন গোলাপ মিয়া। ঘরের খুব কাছে ইটভাটা। ভোর পাঁচটায় হাজির হন গোলাপ। এরপর আট থেকে দশটা ইট মাথায় নিয়ে শুরু হয় তাঁর কাজ। ইট টানেন সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার ইট টানতে পারেন। বিনিময়ে পান মাত্র ১৫০ টাকা। এ টাকায় তাঁর সংসার আর চলছে না। তবু ইটখোলা ছেড়ে যেতে পারছেন না। কারণ, তিনি ১০ হাজার টাকা দাদন নিয়েছেন মালিকের কাছ থেকে।
গোলাপ মিয়ার মতো রাজধানীর আশপাশের প্রায় ৮০০ ইটভাটায় এক লাখের বেশি শ্রমিক দাদন নিয়ে কাজ করছেন। শ্রমিকদের অভিযোগ, শ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাঁদের। সরেজমিনে রাজধানীর কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের ইটভাটাগুলোতে গিয়ে পাওয়া গেছে এই চিত্র।

দাদনের জালে জড়িয়ে গোলাপের মতো শ্রমিকেরা হাঁসফাঁস করলেও বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির মহাসচিব আবু বকর প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, শ্রমিকদের অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়। এই টাকার নামই দাদন। দাদনের টাকা আর শ্রমিককে ফেরত দিতে হয় না। দাদন নিয়ে শ্রমিকেরা ইটভাটায় কাজ করে ভালো টাকা উপার্জন করছেন।
আবু বকর জানান, রাজধানীর আশপাশে ৮০০ ইটখোলা রয়েছে। প্রতিটি খোলায় কমপক্ষে ২০০ শ্রমিক কাজ করছেন। সেই হিসাবেই রাজধানীর আশপাশে ১ লাখ ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, দাদন দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করাতে বাধ্য করানো রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ।
কেরানীগঞ্জের জাজিরার চরের ইটখোলাতে গিয়ে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার তীরের ইটভাটাগুলোতে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের অধিকাংশ এসেছেন কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর ও বরিশাল থেকে। প্রত্যেক শ্রমিক ৬ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাদন নিয়েছেন। ইট তৈরি থেকে ইট পোড়ানোর কাজে নিয়োজিত এই শ্রমিকেরা গড়ে ৪ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে থাকেন। শ্রমিকেরা বুড়িগঙ্গার তীরে ইটখোলায় ছোট্ট ছোট্ট ঘর তৈরি করে পরিবার নিয়ে থাকছেন। সেখানে শত শত শিশু মা-বাবার সঙ্গে থাকছে। ৮ বছর থেকে ১৪ বছরের কয়েক শ শিশু মা-বাবার সঙ্গে ইট টানার কাজ করছে।
শ্রম আইন বলছে, একজন শ্রমিক প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করবেন। কিন্তু ইটভাটার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভাটায় শ্রমিকদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। তাঁদের দিন-রাত কাজ করতে হয়।
শ্রমিকেরা মালিকের কাছ থেকে সরাসরি দাদন নেন না। দাদন দেন সরদার। সরদার হলেন শ্রমিকদের এলাকার একজন, যিনি ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে শ্রমিক কেনেন। প্রতিটি ইটভাটার মালিক প্রতিবছর শ্রমিক কেনার জন্য সরদারদের ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন দেন। সরদারেরা যাঁর যাঁর এলাকা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসেন।
জাজিরার চরে বাদশা ইটভাটার সরদার আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কিশোরগঞ্জ থেকে ৬০ জন শ্রমিক নিয়ে এসেছেন। প্রত্যেক শ্রমিককে তিনি ১২ হাজার টাকা করে দাদন দিয়েছেন। আর এসব শ্রমিক গড়ে মাসে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় করেন। তবে কাজ ছেড়ে চলে যেতে চাইলে দাদন হিসেবে নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে যেতে হবে।
ইটভাটার শ্রমিক আহম্মদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, আগে তিনি ঢাকায় রিকশা চালাতেন। তাঁর প্রতিদিন আয় ছিল পাঁচ শ থেকে ছয় শ টাকা। কিন্তু এখন দিনে তাঁর আয় মাত্র ১৫০ টাকা। দাদন নেওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি এখানে কাজ করছেন।
নেত্রকোনা থেকে আসা আরেক শ্রমিক কালাম মিয়া বলেন, পাঁচ শ টাকার নিচে গ্রামে ধান কাটার একজন শ্রমিক পাওয়া যায় না। অথচ এখন মাত্র দেড় শ টাকায় ইটভাটায় কাজ করতে হচ্ছে।
অন্তত ৫০ জন শ্রমিক বলেন, ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় আজকাল কোনো শ্রমিক পাওয়া যায় না। অথচ দাদনের ফাঁদে ফেলে সর্দার আর মালিকেরা তাঁদের ঠকাচ্ছেন।
জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকালের মধ্যেই ইটভাটায় আমাদের কর্মকর্তাদের পাঠানো হবে। দাদন দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করানো মালিক ও সরদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1166676