৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৪২

‘মনু-ধলাই আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে’

ওই দুই রাক্ষসে আমাদের সব গিলে খেয়েছে। হঠাৎ উত্তাল হয়ে আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। একবার নয়। দু’বারও নয়। এ বছর গেল দু’মাসের মধ্যে এ পর্যন্ত পাঁচবার তাদের ভয়ঙ্কর রূপ দেখিয়ে আমাদের সর্বস্বান্ত করেছে। এখন নিজে চলবো কিভাবে। আর সংসার চালাবো কি করে। ধলাই নদীর তীরবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের বাদে করিমপুর, করিমপুর, জালালপুর, বাসুদেবপুর সুরানন্দপুর, মইর আইলপুর, রুপেসপুর, রামকৃষ্ণপুর, রামচন্দ্রপুর ও উবাহাটা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত সবজি ও বোরো ধানচাষিরা এখন এমন দুশ্চিন্তায়। তাদের মত ক্ষতিগ্রস্ত একই উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়নের ১০-১৫টি গ্রাম ও পৌরসভা এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। কারণ ওই এলাকায় কয়েকটি স্থানে ধলাই নদীর বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে সব ভাসিয়ে নিয়েছে। একই অবস্থা মনু নদীরও। তিন উপজেলার কয়েকটি স্থানে ভাঙন ও ছোট-বড় প্রায় ৩৫টি স্থানে ভাঙনের ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকির মুখে পড়েছেন নদীতীরের কয়েক হাজার স্থানীয় লোকজন। ভারী বৃষ্টি আর উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি নাব্যতা হ্রাসের কারণে ধারণক্ষমতা না থাকায় নদী দু’টির পাড় ভেঙে পানি হানা দেয় তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, অনেকটা জোয়ার-ভাটার মতো ওই পানি আটকে থাকে না বেশিদিন। ১-২ দিনের মধ্যেই নেমে যায় নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠা পানি। কিন্তু ওই পানি নেমে গেলেও পানির সঙ্গে আসা পলি মাটিতে সবজি আর ধান ক্ষেতের ঘটে সলিল সমাধি। নদী দু’টির দু’কূলের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে গ্রামের পর গ্রাম, বাড়ি-ঘর আর ক্ষেত খামার ডুবিয়ে বার বার স্থানীয় বাসিন্দাদের সর্বস্বান্ত করলেও রহস্যজনক কারণে হয় না ওই ভাঙা বাঁধের মেরামত। বছরের পর বছর বাঁধগুলো থাকে যেই সেই। শুধু বর্ষা মৌসুম এলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুরু হয় হৈ চৈ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এমন অভিযোগ স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের। তারা জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা আর জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাসের ফুলঝুরিই যেন সান্ত্বনা পুরস্কার। জানা গেল মনু আর ধলাই। এক সময় দু’টিই ছিল জেলার খরস্রোতা নদী। ওই নদী দু’টিরই উৎপত্তিস্থল ভারত। দু’পাশে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ী টিলায় বেষ্টিত নদী দু’টি বয়ে গেছে জেলার কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর ও মৌলভীবাজার উপজেলার উপর দিয়ে। নানা কারণসহ এখন নাব্যতা হ্রাসে নদী দু’টির ঐতিহ্য নেই বললেই চলে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে হাঁটু পানি, কোমর পানি আর শুকনো মৌসুমে নদী জুড়ে ধূধূ বালুচর। গতকাল সরজমিন নদীভাঙনের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গেলে বাদে করিমপুর গ্রামের নানু মিয়া (৫৫), মিজান উদ্দিন (৪০), ইমান উল্লাহ (৭০), সুরান্দ গ্রামের আবদুল কাদিও (৫৬), কোনাগাঁও গ্রামের আরজদ মিয়া (৪৫), চাম্পা বেগম (৪৮), কদরুন নেছা (৫০)সহ সবজিচাষিরা জানান, আমাদের এলাকা শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন রবিশস্য চাষের জন্য বিখ্যাত। জেলার মধ্যে রবিশস্যের ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া অঞ্চল। কিন্তু আমাদের এই ঐতিহ্য আর ধরে রাখতে পারছি না এই দুই নদীর কারণে। সংশ্লিষ্টরা নদী শাসনের উদ্যোগী না হওয়ায় প্রতিবছর কয়েকবার নদীর দু’কূলের বাঁধ ভেঙে তীরবর্তী গ্রামগুলোর সবই কেড়ে নেয়। এ বছরও সংসারের লোকজন নিয়ে খেয়ে-দেয়ে বাঁচার মতো কোনো সবজি কিংবা বোরো ধান অবশিষ্ট রাখেনি বাঁধভাঙা ওই দু’নদীর পানি। বাদেকরিমপুর গ্রামের চাষি হারুন মিয়া ও তার স্ত্রী ছালেখা বেগম জানান একটি এনজিও সংস্থা থেকে থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তারা ৩ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করেছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত পাঁচবারই তাদের ক্ষেত নষ্ট করে বাঁধ ভাঙা নদীর পানি। এখন ১০ জনের সংসার চলবে কিভাবে আর সপ্তাহে ৬৫০ টাকা হারে ঋণের কিস্তি দেবো কি দিয়ে। বাসুদেবপুরের সবজিচাষি বাবুল চন্দ, প্রণয় চন্দ ও সুরানন্দ পুরের সুনু মিয়া বলেন আমার ৩ বিঘা জমি গ্রাস করেছে ধলার নদীর বাঁধভাঙা পানি। মাত্র দু’দিন থেকে ওই পানি চলে গেছে। কিন্তু পলি মাটি দিয়ে সব সবজি আর ধান কবর দিয়ে গেছে। এখন সবজি গাছগুলোরও চিহ্নি দেখা যায় না। ১৫-২০ হাজার টাকা ঋণ ধার করে ওই সবজি চাষ করেছিলাম এখন আমার সব শেষ। এখন ঋণ দেবো কি করে। আর খাব কি বেঁচে। তাদের মতো দু’নদীর তীরবর্তী গ্রামের কয়েক হাজার চাষি হেক্টরের পর হেক্টর জমি চাষ করেছিলেন মিষ্টি কুমড়া, লাউ, জালিকুমড়া, ঢেঁড়স, মুখি, বরবটি, লালশাক, নালি শাক, ঝিঙা, পুঁইশাক, করলা, চিচিংগা, পইঠা, ডাঁটা শাকসহ নানা জাতের গ্রীষ্মকালীন সবজি। ফলনও হয়েছিল ভালো কিন্তু এখন কিছুই নেই। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায় এবছর পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যায় জেলায় আংশিক ও সম্পূর্ণ মিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৭ হাজার ৪শ ৩২ হেক্টর বোরো ধানের জমি। আর সবজি ৮০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে কমলগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪শ’ হেক্টর বোরো আর সবজি ৫০ হেক্টর। আর কুলাউড়ায় ৪ হাজার ৫শ’ হেক্টর বোরো আর সবজি ৩০ হেক্টর। তবে জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায় এই ক্ষয়ক্ষতি প্রতিদিনই হালনাগাদ করা হচ্ছে। মুন্সীবাজার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো: নওরুজ বলেন, বার বার নদীর বাঁধভাঙা স্থান দিয়ে গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও এখন মেরামত করা হয়নি। ওই স্থানগুলো মেরামত না করায় নতুন করে এর আশপাশ এলাকায়ও ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারি তরফে প্রাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা পর্যাপ্ত নয় বলে তিনি অভিযোগ করেন। কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য অধ্যাপক মো: রফিকুর রহমান বলেন, জেলার শস্যভাণ্ডার হিসেবে এই উপজেলার খ্যাতি। কিন্তু নদীভাঙনে তীরবর্তী গ্রামগুলোতে এখন আর সবজি চাষের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছেন না চাষিরা। খরস্রোতা ধলাই ও মনু ভরাট হয়ে যাওয়াতে এখন বর্ষার সময় নদীতীরের একাধিক স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এখন পানি উন্নয়ন বোর্ড যদি উদ্যোগী না হন তাহলে সবজি ক্ষেতের পাশাপাশি তীরবর্তী গ্রামগুলোই বিলীন হয়ে যাবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এখনই ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো মেরামতের প্রয়োজন। তবে আশা করছি পানি কমতে শুরু করলে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন জেলার সবক’টি নদীর তীরবর্তী মানুষের ক্ষতি এড়াতে আর নদী বাঁচাতে ড্রেজিং আর দীর্ঘস্থায়ী বাঁধ নির্মাণেরও প্রয়োজন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63890