৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৩৬

হাওরে কিস্তির খড়্গ

ত্রাণ অপ্রতুল, পৌঁছেনি প্রকৃত কৃষকের কাছে

নেত্রকোনা মোহনগঞ্জের হাওরে ধান-মাছ হারিয়ে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে থাকা বর্গাচাষী জেলেদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তি আদায়ে এনজিও কর্মীরা কঠোরতা প্রদর্শন করে চলেছেন। কিস্তির ১১শ’ টাকার মধ্যে এক হাজার টাকা দিলেও তারা নেয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আরও একশ’ টাকা জোগাড় করে কিস্তির পুরো ১১শ’ টাকা হাতে দিলে এনজিও কর্মীরা বাড়ি ছাড়ে। কখনও কখনও ঋণ পরিশোধ সত্ত্বেও নতুন ঋণ দিচ্ছে না এনজিওগুলো।

জামালগঞ্জের হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলডুবির ঘটনার ক’দিন পর থেকেই হাওরে মাছ ও হাঁসের মড়কের পর এবার কবুতরের মড়ক দেখা দিয়েছে। নতুন করে অজানা ভাইরাসের কারণে কৃষক পরিবার ও খামারিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। খামারিরা কবুতরগুলোকে নিজে খাবার দেয়ার পাশাপাশি উন্মুক্ত হাওরের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে খাবার আহরণ করার জন্য ছেড়ে দিত। অবশ্য উপজেলা প্রাণিসম্পদের দায়িত্বরত কর্মকর্তা বলেছেন রানীক্ষেত রোগের কারণেই কবুতরের মড়ক হয়েছে। সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে বিএনপি ত্রাণ বিতরণ করেছে। হাকালুকি হাওরের তীরের পাঁচ উপজেলায় নেই কোনো ন্যায্যমূল্যের দোকান। দু’দফা ত্রাণ বিতরণ হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। মঙ্গলবার পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কাছে পৌঁছায়নি সরকারি সহায়তা বা ত্রাণ। ফলে হাওর তীরের কৃষককুল এখনও হতাশায় রয়েছেন। যুগান্তর প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

মোহনগঞ্জ ও বারহাট্টায় (নেত্রকোনা) : পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যায় ফসলডুবি ও মাছের মড়কের পর সোমবার মোহনগঞ্জের হাওর গ্রাম করাচাপুরের জেলেপাড়া সরেজমিন ঘুরে জেলে-জেলেনিদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। ওই করাচাপুর গ্রামে ৩৫০ পরিবার বসবাস করে। এর মধ্যে জেলেপাড়ায় হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে আছে ১২০ পরিবার। হিন্দু পরিবার ৮৫টি। জেলে পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা জয়দেব সরকার, রতন সরকার, ছাহেরুল, অনিতা রানী, সবিতা রানী, ববিতা রানী, বিজয় সরকার জানান, আমরা জেলে পাড়ার বাসিন্দারা সবাই ঋণী। মাছ ধরে বিক্রি করাই আমাদের পেশা। একটুখানি সুখ-শান্তির আসায় আমরা সবাই ৩-৪টি এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ করি এবং জমি জমা ও বর্গা নিয়ে ধানের আবাদ করি। কিন্তু বন্যায় সব শেষ। তারা বলেন, আমরা এখন কিস্তির জ্বালায় অস্থির। রাতে ঘুমাতেও পারি না। কারণ রাত পোহালেই কিস্তির তাগিদ। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, পপি ও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প থেকে ঋণ গ্রহণ করে জেলেপাড়ার সব বাসিন্দাই। ওই জেলেপাড়ার বাসিন্দা এবং ৭, ৮ ও ৯ ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য প্রভাতী রানী দাস বলেন, ব্র্যাকের ঋণ পরিশোধ করা সত্ত্বেও লনী রানী, অজন্তা রানীকে নতুন ঋণ দেয়া হচ্ছে না। এমনকি অজন্তা রানীকে সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিয়ে নাম কেটে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। একইভাবে সীমা ও ঝুমা কিস্তি পরিশোধ করা সত্ত্বেও ‘আশা’ নতুন কোনো ঋণ দেয়নি। ব্র্যাকের মাঠকর্মী সুমি আক্তার মোবাইল ফোনে বলেন, একজন ঋণগ্রহীতা ঋণ তুলে অন্যকে দেয়ায় নতুন ঋণ বন্ধ রেখেছি।

জেলেদের দুর্দিনে স্টেশনে থাকেন না মৎস্য কর্মকর্তা : মোহনগঞ্জের হাওরে পাঁচশ’ ১০ মেট্রিকটন মাছ মরে জেলেদের চরম দুর্দিন চলছে। এখানে প্রায় সাত হাজার জেলের জীবিকা বন্ধ হয়ে আছে। এই জেলেদের জন্য সহায়তার কোনো সুসংবাদ দিতে পারেননি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা। সূত্রমতে, ওই মৎস্য কর্মকর্তা স্টেশনে থাকেন না। জানতে চাইলে মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা নেত্রকোনা সদরে থাকার কথা স্বীকার করেন। এদিকে বারহাট্টা উপজেলা সাহতা ইউনিয়নে ৫শ’ কৃষক পরিবারের মধ্যে ৩৮ কেজি করে ত্রাণের চাল ও নগদ ৫০০ টাকা মঙ্গলবার বিতরণ করা হয়েছে। সাহতা ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত এই চাল বিতরণ করেন নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান, নেত্রকোনা পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী।

কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) : হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওর তীরের কোনো উপজেলায় ন্যায্য মূল্যের দোকান বা ওএমএসের দোকান নেই। তাছাড়া চালের ঊর্ধ্বমুখী বাজার। ফলে কৃষকরা পড়েছেন মহাবিপাকে। খুচরা বাজারে সর্বনিন্ম চালের দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। দাম দিয়ে চাল কেনা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ৩০ এপ্রিল রোববার সুনামগঞ্জ সফরকালে খাদ্যমন্ত্রীকে দুর্গত এলাকার প্রতিটি ইউনিয়নে ওএমএসের দোকান খোলার নির্দেশ দেন। ইউনিয়নে তো দূরের কথা হাকালুকি হাওর তীরের কোনো উপজেলায় ওএমএসের দোকান নেই।

সুনামগঞ্জ ও জামালগঞ্জ : সুনামগঞ্জের আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করতে এসে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান অভিযোগ করেছেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের ফলে ও হাওর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে সরকারি দলের সিন্ডিকেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির ব্যাপক লুটপাট দুর্নীতি অনিয়মের কারণে সুনামগঞ্জ জেলার সব হাওরের শতভাগ ফসল তলিয়ে যায়। মঙ্গলবার দুপুরে সুনামগঞ্জের দেখার হাওরসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন হাওর এলাকা পরিদর্শনের পূর্বে নীলপুর গ্রামে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির পক্ষ থেকে আগামী ছয় মাসের জন্য সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা, হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, কৃষিঋণ মওকুফ ও নতুন ঋণ প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ওয়ার্ড পর্যায়ে খোলাবাজারে চাল বিক্রি, হাওরের মানুষের জন্য জলমহাল উন্মুক্ত করাসহ ৯ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। পরে সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের ছলুরগাঁও গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন আবদুল্লাহ আল নোমান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুল হক আছপিয়া, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা.শাখাওয়াত হাসান জীবন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল প্রমুখ।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করল বিএনপি। সোমবার দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও ত্রাণ কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী আবদুল্লাহ আল নোমান বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা মুরাদপুরে ত্রাণ বিতরণ করেন। ১০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা মুরাদপুর বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় কৃষকদের মধ্যে সোমবার বিকালে বিএনপির পক্ষে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। ১০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র কৃষককে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এ সময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তৃতা করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন, প্রকাশনা সম্পাদক সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব, বানিয়াচং উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ বশির আহমেদ প্রমুখ।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/03/121838