৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৩৫

ধানক্ষেতে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী নেক ব্লাস্ট

লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা * পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল * কীটনাশক প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না

রংপুর বিভাগের আট জেলা ও বগুড়ায় বোরো ধানক্ষেতে মহামারী আকারে নেক ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পরায় কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত রংপুর বিভাগে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন খোদ কৃষি বিভাগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রংপুর আঞ্চলিক অফিস সূত্র বলছে- প্রায় ২৫ শতাংশ ধানের ক্ষেত নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন, আক্রান্ত ক্ষেত সংখ্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। স্থানীয় কৃষকরা এ পরিস্থিতি বোরো মৌসুমে খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস মনে করছেন। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধির পাঠানো খবর-

রংপুর : রংপুর বিভাগে সর্বাধিক ধান উৎপাদন হয়ে থাকে দিনাজপুরে। শনিবার ঘুরে দেখা গেছে, জেলার প্রায় ১৩টি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ক্ষেতে দেখা দিয়েছে নেক ব্লাস্ট রোগ। এতে কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।

বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর ইউনিয়নের গাণ্ডারা গ্রামের বর্গাচাষী খোকা দেব শর্মা জানান, অন্যের জমি চুক্তিতে চাষ করেছি। জমির ধান নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা করা যাচ্ছে না জমির ফসল। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত জমির পরিমাণ। এ অবস্থায় জমির মালিককে কী দেব। আর সার, কীটনাশক ও তেলের টাকা পরিশোধ করব কিভাবে। সরকার যদি ভর্তুকির ব্যবস্থা না করে তা হলে আমাদের পথে বসতে হবে।

একই উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের আওলাখুড়ী গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম জানান, ঠিক যে মুহূর্তে ফসল ঘরে তোলার আনন্দে বিভোর কৃষক, তখন নেক ব্লাস্ট ঘাতক রোগ বোরো ধানের সর্বনাশ করেছে। কৃষকের ঘরে এখন বিষাদের ছায়া। সোনালি হাঁসির পরিবর্তে কৃষকের ঘরে ঘরে এখন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। এখন আমাদের কী হবে। কিভাবে চলবে আগামী দিনগুলো। এই পরিস্থিতি জেলার সর্বত্র। জমিতে গিয়ে হতাশার কান্না আর নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকেন কৃষক। বুকের মাঝে চাপা আর্তনাদ। কিন্তু কে শুনবে তাদের হতাশা আর আর্তনাদ। ফসলের রোগ সমাধানের জন্য পাগলের মতো একবার ছুটছেন কৃষি কর্মকর্তা কার্যালয়, আরেকবার বিভিন্ন কীটনাশকের দোকানে। তবুও মিলছে না প্রতিকার। কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পারলে এবারে বোরো মাড়াই মৌসুমে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেবে।

বীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কখনও গরম আবার কখনও শীত। আবার হঠাৎ বৃষ্টি ভোরে, রাতে কুয়াশা। এমন বৈরী আবহাওয়া নেক ব্লাস্ট রোগের মূল কারণ। আবহাওয়ার পরিবর্তন অর্থাৎ রোদের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আমরা আশা করছি। তবে কৃষকদের কীটনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেয়ার কারণে রোগটি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

চিরিরবন্দরের নশরতপুর, তেঁতুলিয়া, সাতনালা, আলোকডিহি, ইসবপুর, সাঁইতাড়া, আবদুলপুর, পুনট্টি ইউনিয়নে ইরি-বোরো ক্ষেতে ব্যাপক হারে নেক ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে পার্বতীপুর কৃষি কর্মকর্তা আবু ফাত্তাহ মো. রওশন কবির জানান, কৃষকদের আক্রান্ত ক্ষেতে ছত্রাকনাশক বিভিন্ন ধরনের ওষুধ স্প্রে করতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

রোববার রংপুরের মিঠাপুকুরের প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, নেক ব্লাস্ট রোগের কারণে বোরো ধানের শীষ শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০ হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে এই উপজেলায়। মাসখানেক হল কৃষি বিভাগের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর শুক্র ও শনিবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এ তথ্য জানান মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ খোরশেদ আলম।

এ ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে রংপুর কৃষি সম্প্রসার অধিদফতরের উপ-পরিচালক সম আশরাফ আলী জানান, জেলার আট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ায় উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে ‘ধানের ব্লাস্ট রোগ দমনে কৃষক ভাইদের করণীয়’ শীর্ষক প্রচারপত্র বিতরণসহ উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ দিচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর আঞ্চলিক অফিস সূত্র জানায়, এ অঞ্চলে গত শনিবার পর্যন্ত নেক ব্লাস্ট আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৬০ দশমিক ৫ হেক্টর ছাড়িয়ে গেছে। তবে কৃষকদের দাবি তা দ্বিগুণ হবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট গাজীপুরের পরিচালক (গবেষণা, চলতি দায়িত্ব) ড. মো. আনছার আলী এ রোগ প্রতিরোধে কৃষকদের সচেতন করতে একটি প্রচারপত্র বিতরণ করেছেন, যা জেলায় জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে বিতরণ করা হচ্ছে। সব মিলে পরিস্থিতি দেখে মনে হয় হাওরের পর এবার উত্তরে বোরো ধানের নেক ব্লাস্ট রোগ কৃষকের সর্বনাশ করেছে। যার প্রভাব পড়বে আগামী আমন ধান উৎপাদন মৌসুমে।

বগুড়া : জেলার শাজাহানপুর উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি-২৮ জাতের ধানের শীষে চিটা দেখা দিয়েছে। কৃষি বিভাগ ধানে নেক ব্লাস্ট রোগ আক্রান্ত হওয়ার দাবি করে কীটনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছে। এতেও কাজ না হওয়ায় ফলন নিয়ে কৃষকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। খরচ করে লাভ না হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় অনেক কৃষক ধান কাটা মাড়াই থেকে বিরত রয়েছেন।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাজাহানপুর উপজেলার মধ্যে আমরুল ইউনিয়নের ফুলকোট গ্রামে নেক ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। ফুলকোট দক্ষিণপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল বাছেদ জানান, তিনি এবার তিন বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ করেন। এর মধ্যে দুই বিঘা জমিতে আক্রান্ত হয়েছে বেশি। কৃষি বিভাগের পরামর্শে চারবার কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন। এর পরও রোগ থেকে রেহাই পাননি। গত বছর ওই তিন বিঘা জমি থেকে ১০০ মণ ধান পেয়েছিলেন। এবার সর্বোচ্চ ২৫ মণ ধান পাওয়া যেতে পারে। কাটা মাড়াই খরচের ভয়ে তিনি জমি থেকে ধান কাটছেন না। একই গ্রামের আজিজুল হক, আবদুল জলিল, ছায়েদ আলী, মোস্তাকিম, আবুল হোসেন, আবদুল হাকিম প্রমুখ কৃষকের ধানক্ষেতে নেক ব্লাস্ট আক্রান্ত হয়েছেন। তারাও খরচ উঠবে না, তাই ধান কাটতে সাহস করছেন না।

কৃষি কর্মকর্তা সোহেল মো. শামসুদ্দিন ফিরোজ জানান, ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলেই কৃষকদের ধান কেটে নিতে বলা হয়েছে। নেক ব্লাস্টের আক্রমণে তেমন ক্ষতি হবে না উল্লেখ করেন।

নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) : নাগেশ্বরীতে নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে ধান উৎপাদনে ধস নেমেছে। বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে মাত্র ২-৩ মণ। লোকসানে পড়েছে কৃষক। চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের সর্বত্রই ধানের শীষ বের হওয়ার আগে অথবা পরে বাইকোলারিস অরাইজি ছত্রাক সৃষ্ট নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয় বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। দিনে প্রচণ্ড গরম ও রাতে ঠাণ্ডা অবস্থা বিরাজ করায় রোগটি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। জীবাষু ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে তা দ্রুত এক জমি থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্য জমিতে। রোগের আক্রমণে ধানের পাতা, গিট, শীষের গোড়া, শাখা-প্রশাখা কালো, দুর্বল হয়ে এবং পানি ও খাদ্য না পেয়ে পুষ্ট হওয়ার আগে চিটা হয়ে যায় শীষের সব ধান। রোগের দমন ব্যবস্থাপনায় কৃষি অফিস থেকে প্রচারণা চালালেও বিস্তার ঠেকানো যায়নি। ধস নেমেছে ধান উৎপাদনে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/03/121832