৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:১৬

কাউয়ারা সব উড়াল দেবে

সহজ কথা

 আলফাজ আনাম :
বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে সংসদ নির্বাচন হতে আরো পৌনে দুই বছর বাকি। এর মধ্যেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জেলায় সফরে গিয়ে নিজ দলের পক্ষে ভোট চাইছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ দলের মধ্যে যে মারাত্মক বিরোধ ও বিভেদ আছে তা নিরসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দলীয় কোন্দল নিরসনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। ফলে তার কথার মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থানের চিত্র যেমন বেরিয়ে আসছে, তেমনি কিছু আত্মসমালোচনামূলক কথাও তিনি বলছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের এক প্রতিনিধিসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে নেতাকর্মীদের সতর্ক করে সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মতা বেশি দিন থাকে না। তাই মতার অপব্যবহার করবেন না। আওয়ামী লীগ মতায় না থাকলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালাতে হবে। সেটা কি ভাবেন না? এখন যে টাকা-পয়সা রোজগার করছেন, এই টাকা নিয়ে তখন পালিয়ে বেড়াতে হবে।’

আওয়ামী লীগ আট বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। এই সময়ে দলের নেতাকর্মীরা নানাভাবে অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন। দেশে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে, তার সাথে স্থানীয়পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঠিকাদারি, নিয়োগপ্রক্রিয়াসহ নানাভাবে সম্পৃক্ত। ফলে সরকারি সম্পদ ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্থবিত্তের মালিক হতে দলের মধ্যে এখন প্রবল প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নিয়েছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা, আইন ও সালিসকেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল ২০১৬ সালেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। আফ্রিকার কোনো দেশেও রাজনৈতিক দলের ঘরোয়া কোন্দলে এত মানুষের প্রাণহানি হয় বলে মনে হয় না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নিজেই এখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিষয়টি ঠিকই ধরতে পেরেছেন। এ কারণে দল ক্ষমতায় না থাকলে যে, এই টাকা রক্ষা করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ টাকা রক্ষার ভয় দেখিয়ে হলেও দলকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে শক্ত সুবিধাভোগী শ্রেণী গড়ে উঠেছে, তা বুঝতে পেরে দলের সাধারণ সম্পাদক তা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন সাধ্যমতো। দলের নানা গ্রুপের মধ্যে বিভেদ-বিভাজন বেড়েছে। বেপরোয়া সুবিধাভোগী শ্রেণীটি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এর আগে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে এখন কাউয়া (কাক) ঢুকছে। দলের জায়গায় জায়গায় কাউয়া আছে। এটি আর চলবে না। দলে পেশাহীন পেশিজীবীর দরকার নেই। ঘরের ভেতরে ঘর করা চলবে না। জমিদারির মতো পদ দখল করে ঘরে বসে থাকা আর চলবে না।’ গত ২২ মার্চ সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগীয় তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি আরো বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আর দেড় বছর বাকি। দলকে জঞ্জালমুক্ত করতে হবে। হাতে সময় খুব কম। এখন আর সেøাগান নয়, এবার অ্যাকশন হবে, অ্যাকশন। নেতাকর্মীদের কথা কম বলে বেশি বেশি করে কাজ করতে হবে। আর আওয়ামী লীগকে হাইব্রিড নেতাদের কাছ থেকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবাইকেই নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নামে, আওয়ামী লীগের নামে দোকান খোলা যাবে না। আজ ব্যাঙের ছাতার মতো এসব দোকান গড়ে উঠছে। আওয়ামী প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, প্রজন্ম লীগ, প্রবীণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ। এসব চলবে না। এদের গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন।’
আসলে আওয়ামী লীগের ঘরের মধ্যে এখন ‘অনেক ঘর’ তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এক হাতে দল ও দেশ চালাচ্ছেন বলে তার ছায়ায় এই ঘরগুলো অনেক সময় দেখা যায় না। ওবায়দুল কাদের যত এদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করবেন, ততই ক্ষমতার শেষ বেলায় এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। কারণ, তিনি বলছেন এরা দলের সব পদ দখল করে রেখেছে।
আট বছর ধরে বাংলাদেশে কোনো বিরোধীদলীয় রাজনীতি নেই। ফলে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয়পর্যায়ের রাজনীতিতে বিরোধী দল নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মোটামুটি লক্ষ্য স্থির করে ফেলেন, কে কিভাবে শর্টকার্ট পদ্ধতিতে বিপুল টাকা-পয়সার মালিক বনে যাবেন। টেন্ডার, নিয়োগবাণিজ্য, ব্যাংক ঋণের নামে টাকা লোপাট এবং কমিশন বাণিজ্যের মতো বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন।
প্রকৃতপক্ষে একদলীয় শাসন কায়েম করতে গিয়ে সুবিধাভোগী শ্রেণী দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের সুবিধা হচ্ছে, যেকোনো বিষয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো; যেমন কোথাও প্রভাব বিস্তার নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল হলে এর কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ছে। এমন অভিযোগ ওবায়দুল কাদেরও করছেন। গত ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে মুজিবনগর দিবসের আলোচনা সভায় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে ফার্মের মুরগি ঢুকেছে। ফার্মের মুরগির কারণে দেশী মুরগি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। দেশী মুরগি দরকার, ফার্মের মুরগি নয়। ফার্মের মুরগি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। চার দিকে আতি নেতা, পাতি নেতায় ভরে গেছে। তবে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করা চলবে না।’ অবশ্য কাউয়া আর ফার্মের মুরগির উপমা নিয়ে দলের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার এখন দায়িত্ব হলো, কাউয়া আর ফার্মের মুরগির একটা তালিকা তৈরি করা এবং এদের দল থেকে বের করে দেয়া। কিন্তু কাজটা এত সহজ নয়। কারণ, লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে।

নেতাকর্মীরা দুর্নীতিতে তখন জড়িয়ে পড়ে যখন দলের ওপরতলার নেতাদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠতে থাকে। ২০০৮ সালে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় মন্ত্রী ও এমপিদের সম্পদের যে হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হয়েছিল তাতে অনেক মন্ত্রীর আয়-ব্যয়ের হিসাবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা গেছে। তিন বিঘা জমির মালিক হয়ে গেছেন তিন হাজার বিঘা জমির মালিক। রাতারাতি অনেকে একাধিক চিংড়িঘেরের মালিক বনে গেছেন। গত তিন বছরে তাদের সম্পদের পরিমাণ আরো বহু গুণ বেড়ে গেছে। নেতাদের বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার খবর তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানেন না, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর তৃণমূলের নেতারা বড় নেতাদের প্রশ্রয়ে ও তাদের আশ্রয় করেই বেড়ে উঠেন। তারাও সম্পদ বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন।

বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর অনেক বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংক লোপাটের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া বড় আকারের দুর্নীতি ঘটে না, তা এ দেশের শিশুরাও জানে। কানাডায় কিভাবে ‘বেগম পাড়া’ গড়ে উঠেছে তাও দেশের রাজনৈতিক অন্দরমহলে অনেক চর্চিত বিষয়। এ কথাও সত্য, দুর্নীতির সাথে যে শুধু রাজনৈতিক নেতারা জড়িত তা নয়, ব্যবসায়ী, পুলিশ, মিডিয়ার লোক, উকিল, আমলা সব মিলে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী গড়ে উঠেছে। এরা নির্বাচনবিহীন একটি সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সত্যিই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়, এরা কি কোনো কাজে আসবে না? না, আসবে না। জনগণের মনোভাব পাল্টানো এদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেই আওয়ামী লীগের ভয়। আর এ কাজটি করতে পারেন কেবল দলের নেতাকর্মীরা।
এ কারণেই নির্বাচনের দুই বছর আগে থেকেই আওয়ামী লীগকে ভোটের রাজনীতির হিসাব করতে হচ্ছে। এক দিকে বিরোধী দলের ভোট বিভাজনের পরিকল্পনা করতে হচ্ছে, অন্য দিকে সাধারণ মানুষের মাঝে দলের ইমেজ বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে হচ্ছে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ নয়। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত, সচিবালয় থেকে থানার ওসি পর্যন্ত যে সুবিধাভোগী চক্র গড়ে তোলা হয়েছে, তাদের কাছে সব সময় নির্বাচনের হিসাব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের কাউয়া বা ফার্মের মুরগি বলে নিবৃত্ত করা যাবে না, বরং স্থানীয়পর্যায়ে তারাই বেশি শক্তিশালী। এখন এদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সাধারণ সম্পাদক শুধু দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে তারেক রহমান আর হাওয়া ভবনের দুর্নীতির কাহিনী প্রচার করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করেছিল। তাতে সফলও হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমও ছিল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। ফলে তারেক রহমানকে দুর্নীতির মহারাজা হিসেবে তখন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে বলছেন, দলের নেতাকর্মীরা অবাধে অবৈধভাবে টাকা-পয়সা কামাচ্ছেন, তাতে দলের শৃঙ্খলা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। ফলে এসব নেতা যাতে দলের কাজে মনোযোগী হয়, এ জন্য ‘টাকা রক্ষা’র কথা তিনি মনে করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন যে, এরা দলের ভেতরের কাউয়া। এই কাউয়ারা জানেন, কিভাবে টাকা-পয়সা রক্ষা করতে হয়। এ কারণে বিরূপ পরিস্থিতিতে এরা উড়াল দেবে। এদের আটকে রাখা যাবে না। দলের সাধারণ সম্পাদকের হুঁশিয়ারি থেকে তারা আরো সতর্ক হবে। ক্ষমতা থাকার বাকি সময়ের মধ্যে আরো কিছু অর্থ জমিয়ে উড়াল দেয়ার প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রাখবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও এমন প্রস্তুতির কথা শোনা গিয়েছিল। ২০১৯ সালেও এরা যে উড়াল দেবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
alfazanambd@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/216862