২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৯:২৯

হাওরের কৃষক ছুটছেন শহরে

প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর হাওরবাসী কাজের সন্ধানে এখন শহরমুখী। প্রতিদিন শত শত যুবক ও বয়স্করা পাড়ি জমাচ্ছেন শহরে। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, ধর্মপাশা সহ ১১টি উপজেলার একের পর এক হাওর ডুবায় কৃষক দিশাহারা। এ কারণে এক ফসলি এ বোরো ধানের চাষের ওপর নির্ভরশীল কৃষক পরিবারগুলোর চাষাবাদের গরু আর গোলা এখন শূন্য। পর পর দু-বছর ধরে কষ্টে ফলানো বোরো ধান অকাল বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় গোলায় তুলতে পারে নি এক উড়া ধান। রাখতে পারে নি গোয়ালের গরুর জন্য খড়। হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারের মাঝে এখন কেবলই হাহাকার বিরাজ করছে। নিজের জীবন বাঁচাতে ও ঋণ পরিশোধ করতে এখন গোয়ালে রাখা হালের গরু পানির দামে বিক্রি করছে বিভিন্ন বাজারে কৃষকগণ। সেই বিক্রির টাকা কিছুটা ঋণ পরিশোধ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখন ছুটছে জীবন বাঁচাতে কাজের সন্ধানে চেনা জানা শহরে আবার কেউ অচেনা শহরে। এদিকে জেলায় এক ফসলি বোরো ধান হারিয়ে সর্বত্রই হতাশায় দিন কাটছে দিন মজুর শ্রমিকদের মাঝেও। তারাও প্রতি বছরের মতো এবারও প্রত্যাশায় ছিল বোরো ধান কাটার। এই সময়টায় গৃহস্থ পরিবারগুলোর হাজার হাজার হেক্টর বোরো ধান কাটার আশায় কেউ মাড়াইকল দিয়ে, কেউ চুক্তি ভিত্তিতে জমির ধান কাটে। আর শ্রমিকরা আসত দেশের বিভিন্ন বিভাগ থেকে। ধান কেটে আবার নিজ গন্তব্যে ফিরে যেত। ঐসব শ্রমিকের সঙ্গে এ জেলার শ্রমিকরাও এক সাথে কাজ করে ৬ মাসের খাবারের ধান বা তার সমতুল্য টাকা উপার্জন করতে পারত। এবার অসময়ে পানিতে হাওর ডুবে যাওয়ায় তারাও এখন কাজ না পেয়ে শহরমুখী হচ্ছে। আবার অনেকেই অভাব আসার আগেই চলে গেছে শহরে কাজ করার জন্য। যারা এখনো শহরে যায় নি তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানা যায়, এ জেলার সর্বমোট আবাদি জমির পরিমাণ ৩,৭৯,২১৬ হেক্টর। এবার আবাদ করা জমির পরিমাণ-২,৭৬,৪৪৭ হেক্টর। তার মধ্যে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজারের অধিক হেক্টর জমিতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। আর বাকি জমিতে অন্যান্য ফসল। এসব জমিতে প্রতি বছর ৯লাখ টনের অধিক ফসল উৎপন্ন হয়। যার মূল্য ১৫শ’ কোটি টাকার বেশি। হাওর বেষ্টিত এ জেলার ২৫ লক্ষাধিক জনসাধারণের মধ্যে প্রায় ২০ লক্ষাধিক ওইসব হাওরে গুলোতে চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা পরিচালিত করে। কিন্তু এ বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে তৈরি হাওর রক্ষা বাঁধগুলো সঠিক ভাবে সঠিক সময়ে নির্মাণ না হওয়ায় বাঁধ ভেঙ্গে হাজার হাজার কৃষকের কষ্টার্জিত সোনার ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এই ফসল ফলাতে এনজিও, ব্যাংক ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে নেয়া ঋণ পরিশোধ কিভাবে করবে তা নিয়ে হতাশায় দিন পার করছে হাওর পাড়ের কৃষক। তাই সবাই এখন ছুটছে শহরে শ্রম বিক্রি করার জন্য কেউ বা অচেনা শ্রম বাজারের দিকে। কাজের সন্ধানে সুনামগঞ্জ পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে থেকে আখাউড়া যাওয়া জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের কৃষক মোতালেব মিয়া। তিনি বলেন, ভাই এবার তো সব ধান পানিতে ডুবাই দিছে যে জমিটুকু করছিলাম সেইডাই এইবার পানিতে খাইছে। নিজের জমি কাটার পর অন্যের জমি কাটতাম এবার তাও শেষ। তাই বাঁচার লাগি শহরে তাও আবার সিলেট বিভাগ ছাড়িয়ে আখাউড়ায়। কোনো উপায় নাই। একই এলাকার শ্রমিক ছোট মিয়া বলেন, বাঁচার জন্য এলাকা ছাড়তাছি এলাকা না ছাড়লে কি খামো। কাজ কাম নাই বাঁচতে হইলে খাইতে হইব এরলাইগাই শহরে যাইতাছি। এই বাড় তো সব হাওর ডুবছে এক গোছা ধান কাটতে পারি নাই। এমন কথা শ্রম বিক্রি করতে ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শত শত শ্রমিকর। সুনামগঞ্জ জেলার পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকাগামী মামুন গাড়ির সুপারভাইজার এম এ ছালাম জানান, গত কয়েক সাপ্তাহের বেশি সময় ধরেই এই এলাকার লোকজন ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরে যাচ্ছে। এত লোক এর পূর্বে এভাবে যায় নি। আমাদের সঙ্গে যে পরিমাণ যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি যাচ্ছে কম টাকার পরিবহন করা গাড়িতে। তাই কৌতূহল নিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে এবার নাকি সুনামগঞ্জের সব হাওর পানিতে ডুবে গেছে কাজ নাই, ঘরে খাবার নাই তাই সবাই শহরে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন-হাওর হারিয়ে কৃষক পরিবারগুলো প্রথমে তাদের গোয়ালের গরু বিক্রি করেছে। সেই টাকা দিয়ে কিছুটা ঋণ পরিশোধ করে জীবন বাঁচাতে এখন তারা সবাই পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে কথাটি অপ্রিয় হলেও সত্য।

 

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63419&cat=3/