২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৪২

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা

রমজানের বাকি এখনো মাসখানেক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, রমজানের পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) অনেক আগেই খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে সেসব পণ্য বন্দরে এসেও গেছে। বাজারসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, রমজানে পণ্য বিক্রিতে ব্যবসায়ীদেরও ভালো প্রস্তুতি (আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি) রয়েছে।

অথচ এখনই বেড়ে গেছে দু-একটি পণ্যের দাম। আরো কিছু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ডলারের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা রমজানের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাম্প্র্র্রতিক সময়ে নগদ ডলারের চেয়ে তরল ডলারের দাম বেশি করে বেড়েছে। আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হয়ে থাকে তরল ডলারের মাধ্যমেই। সর্বশেষ দর অনুযায়ী নগদ ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকার নিচে এবং তরল ডলারের দাম উঠেছিল ৮৫ টাকা পর্যন্ত। আর ডলারের মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিটি সামনে এনেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজির অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মে মাসে রমজান শুরু হয়ে যাবে। হঠাৎ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আমার কাছে কারসাজি বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করে দর কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ’
এরপর অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে এক দিনের ব্যবধানেই বৃহস্পতিবার ডলারের দাম প্রায় দুই টাকা পর্যন্ত কমে এসেছে অর্থাৎ ৮৫ থেকে ৮৩ টাকায় নেমে এসেছে বলে জানা গেছে। গত বছর রমজানের আগে তরল ডলারের দাম ছিল ৭৮ টাকা। এ বছরের মার্চের শেষ দিকে এ দাম উঠে ৮০ টাকা ৫০ পয়সা। তারপর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৫ টাকায় উঠেছিল।
জানা যায়, গত কয়েক দিনে বিপিসি, কাফকোসহ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বড় বড় কয়েকটি এলসির পাওনা পরিশোধকে কেন্দ্র করে আমদানি পর্যায়ে তরল ডলারের দর প্রায় ৮৫ টাকায় উঠে যায়। চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম থাকায় মূল্যবৃদ্ধির এই ঘটনা ঘটে। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত মঙ্গল ও বুধবার কয়েকটি ব্যাংকের কাছে চার কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তা ছাড়া অযৌক্তিক হারে দর না বাড়ানোর বিষয়েও ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়। ফলে বৃহস্পতিবার ডলারের দর কমে ৮৩ টাকার নিচে নেমে আসে। কিন্তু এরই মধ্যে বাড়তি দরের দোহাই দিয়ে অনেক আমদানিকারক আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ খুঁজতে শুরু করে।
ব্যবসায়ীরা দাবি করছে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে আমদানি মূল্য পরিশোধে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সব ধরনের পণ্যের ক্রয় খরচও বেড়েছে। এ কারণে রমজানের জন্য যেসব পণ্যের বিশেষ চাহিদা রয়েছে সেগুলোর দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, রমজানের পণ্য আমদানির এলসি অনেক আগেই খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে সেসব পণ্য বন্দরে এসেও গেছে। এই মুহূর্তে রমজানের পণ্যের নতুন এলসি খোলা হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র অবশ্য বলেছে, হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক ডলারের দাম বাড়িয়ে দেয়। যার প্রভাব পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে। আর তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে একশ্রেণির আমদানিকারক।
জানা যায়, রমজানের সময় দেশে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। এর মধ্যে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ উল্লেখযোগ্য। পেঁয়াজের দাম এরই মধ্যে দুই দফা বেড়ে গেছে। ছোলার দামও বেড়েছে খানিকটা। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীরা তেল ও চিনির দাম বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঢাকার বিভিন্ন বাজারের তথ্য অনুযায়ী, দেশি পেঁয়াজের দাম দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২৫ টাকা থেকে বেড়ে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৮ টাকা কেজিতে, যা আগে ছিল ২০ টাকা। সপ্তাহখানেক আগে খোলা চিনির দাম কিছুটা কমেছে, ৭৫ টাকা থেকে নেমে এসেছে ৬৮-৭০ টাকায়। তবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি এখনো ৭২ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিনির এই দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। দাম আরো বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা আভাস দিয়েছে।
মেঘনা গ্রুপের প্রধান বিক্রয় কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন কলের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের দামটা এমনভাবে বেড়েছে যে আমাদের পণ্য আমদানিতে খরচও বেড়েছে। যে কারণে আমাদের আমদানি করা পণ্য তো একটু বেশি দামেই বিক্রি করতে হবে। ’ এই মুহূর্তে কোনো পণ্য বাড়তি দামে কেনা হলে তার প্রভাব কখন বাজারে পড়বে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঠিক কবে থেকে এটার প্রভাব পড়বে বলা কঠিন। তবে এখনই এটা পড়া উচিত। আমরা এখনো লোকসানে আমাদের পণ্য বিক্রি করছি। ’
চিনির মজুদ ও দামের কথা জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সাধ্য অনুযায়ী চিনি আনার চেষ্টা করেছি, যেহেতু রমজানে চাহিদা বেশি থাকে। বাজারে এখনো চিনির দাম বাড়েনি। তবে আমরা এখন কিছুটা লোকসানে বিক্রি করছি। সেটা সমন্বয় করতে গেলে দাম বাড়ানো উচিত। ’
চট্টগ্রাম চেম্বার ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার শুধু ছোলা ছাড়া অন্যান্য পণ্য যেমন তেল, চিনি, মসুর ডালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আমাদের কাছে আমদানির যে তথ্য রয়েছে তা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ বা কোনো কোনো পণ্যে আরো একটু বেশি। আমরাও আশা করছিলাম বাজারটা স্থিতিশীল থাকবে। তবে হঠাৎ কেন ডলারের দামটা এমন বেড়ে গেল, আমরাও বুঝতে পারছি না। এটা বাড়লে কিন্তু মার্কেটে একটা প্রভাব আসবে। আবার যেহেতু কমতে শুরু করেছে সেহেতু রমজানের আগে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কাটা কমে যাবে আশা করছি। ’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতাদের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ছোলা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৭৭-৭৮ টাকা কেজিতে; যেখানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৩-৭৪ টাকা কেজিতে। তবে প্রত্যেক খুচরা বিক্রেতা ছোলা বিক্রি করছেন ১০০ টাকা কেজিতে। টিসিবির তথ্য মতে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫ শতাংশ বেশি দামে।
ট্যারিফ কমিশন ও সরকারি হিসাব মতে, দেশে প্রতিবছর ছোলার চাহিদা রয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার টন; যেখানে শুধু রমজানেই প্রয়োজন হয় ৫০ হাজার টন। গত বছর দেশে মোট ছোলা আমদানি করা হয়েছে দুই লাখ ৫৩ হাজার টন। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আমদানি করা হয়েছে আরো ৫৬ হাজার টন। এখন পর্যন্ত ছোলা আমদানি অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে বেশ কিছুদিন ধরে স্থিতিশীল রয়েছে সয়াবিন তেলের দাম। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায় এবং পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। তবে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকায় এবং পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫২০ টাকা পর্যন্ত।
কারওয়ান বাজারের সোনালী ট্রেডার্সের বিক্রেতা সুমন জানান, খোলা সয়াবিনের দাম একটু কমেছে। তবে শোনা যাচ্ছে, তেলের দাম আবার একটু বাড়তে পারে। কেন বাড়তে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইমপোর্টারদের খরচ নাকি বেশি পড়ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আমাদের তো কিছু করার নাই। যে দামে আমরা পাব, তার থেকে লাভ রেখেই আমাদের বিক্রি করতে হবে। ’
গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ হারে। যদিও তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ছিল পড়তির দিকে। শুধু চলতি মাসেই এক লাখ ১৬ হাজার লিটার অপরিশোধিত ভোজ্য তেল আনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘রমজানে বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। লোভ সামলাতে না পেরে ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগান। কারণ মওকা পেলেই ওনারা প্রফিট বাড়াতে চান। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টাকে পুঁজি করে তাঁরা এই কাজটা করতে চাচ্ছেন। এটা সরকারের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। না হলে ভোক্তারা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ইস্যুতে যেটা হয়েছে সেটা খুবই সাময়িক। এর কোনো প্রভাব রমজানের পণ্যের ওপর পড়বে না বলে আমরা মনে করছি। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নেবে। এটা নিয়ে এখন চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমাদের ব্যবসায়ীদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের প্রচুর পরিমাণ মজুদ রয়েছে, যা প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি। আমরা ছোট বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক, সবার সঙ্গে একটা মিটিং করেছি। সামনের রবিবার ১১টায় সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে আরেকটি মিটিং হবে। ’
কেউ যেন বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে সে জন্যও যথেষ্ট মনিটরিং থাকবে জানিয়ে শুভাশিষ বসু বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব একটি মনিটরিং সেল রয়েছে, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, টিসিবি, ট্যারিফ কমিশনসহ অনেকেই কাজ করবে। অর্থাৎ আমরা বাজারটা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখব, যাতে কোনোভাবেই অহেতুক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা না ঘটতে পারে। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/29/491955