২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৩৭

বিপন্ন হাওর...

ফসলহানির দুর্যোগ সামাল দিতে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা

লুপেশ তালুকদারের বাড়ির সামনে বিশাল জলরাশি। পাঁচ হাল জমি ছিল নিজের অন্যের তিন হাল জমি বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন, এই আট হাল জমির সব ধান গেছে। ১৬টা গরুর ১১টা বিক্রি করে দিয়েছেন পানির দামে। নিজের ভাত নাই। ওদের খাওয়াবেন কি! সেই ধানের ওপরে যে কর্জ ছিল সে সবের দায় চেপেছে ঘাড়ে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। ভেসে গেছে সব স্বপ্ন। যদিও তাদের সব স্বপ্নই ‘স্বল্প মেয়াদি’। তারপরও স্বপ্ন তো। সে সবই ভেসে গেছে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নাইন্দা হাওরে। সামনের দিনগুলোতে বেঁচে থাকবেন কি করে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন তাদের ছয় সদস্যের পরিবারের কাছে।

গত একশ বছরে এমন ঘটনা ঘটেনি। এভাবে ধান ডোবেনি। মাত্র ধানের শীষে দুধ ধরেছিল। বন্যা সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সবকটি হাওর প্লাবিত। হাওর জুড়ে কৃষকের বুকে হাহাকার।

বাংলাদেশের হাওরের অধিবাসীরা যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতই সবার চোখের আড়ালে। বাংলাদেশের আর সব অঞ্চলের চাইতে এই এলাকার মানুষের জীবনধারা আলাদা। কিন্তু শত শত বছর ধরে সেই জীবনধারা বদলায়নি। বান না এলে ফসল ঘরে ওঠে, বান এলে ভাসে সব, সবকিছু ভেসে যায় জলের তোড়ে।

প্রতি তিন বছরে একবার হাওর প্লাবিত হয়। তবে এবারের বন্যা এমন হাহাকার কেন ফেলেছে দেশে? কৃষকের কেন এমন আহাজারি? কেন হাওরের মানুষের জীবন এভাবে থমকে গেছে? অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হাওরের লাখ লাখ মানুষ। শুধুই কী প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নয় আজকে ফসলের এই বিশাল ক্ষতির কারণ দায়িত্ব পালন না করা। হাওরের বাঁধ যদি ঠিক সময়ে শেষ হতো তাহলে এই বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো না বাংলাদেশকে। এখন সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় কিন্তু বাঁধ হয় না। অথচ দীর্ঘকাল ধরে বাংলার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ দিয়ে বন্যার পানি আটকে দিয়েছে। এখন কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এবছরও ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। স্বেচ্ছাশ্রমের বাঁধ যে পানি আটকে দিত ৫৮ কোটি টাকার বাঁধ সেই পানি আটকাতে পারেনি। আর পারেনি বলেই সরকারকে এই বিপদ সামাল দিতে মানুষের জীবন বাঁচাতে নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে হচ্ছে।

হাওর! এ যেন সমুদ্র, যার লোকজ নাম সায়র। হাওর আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক জলাভূমি। শহরের মানুষের কাছে রোমান্টিক একটা উচ্চারণ। কিন্তু হাওর অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের কাছে এই হাওরই জীবিকার একমাত্র আধার। আবহাওয়া ভালো থাকলে মুখে হাসি ফোটে হাওরবাসীর। আর যদি না থাকে! যদি ফসল না হয় দুর্যোগ নেমে আসে মানুষের জীবনে। সম্ভাবনার এই বিশাল জলভূমিকে ঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়নি। পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেনি। কাটেনি দারিদ্র্যের অন্ধকার ।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বিজয় সফটওয়্যার-এর জনক মোস্তাফা জব্বার হাওর অঞ্চলের মানুষ। তিনি বললেন, সময়মত বাঁধ দেয়া হলে এই বিপর্যয় ঘটতো না। বিপর্যয় হওয়ার মূল কারণ মানুষের দুর্নীতি। হাওর এলাকায় হাজার হাজার বাঁধ অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করতে হয়। মাটির এই বাঁধগুলো নির্মাণে দুর্নীতিকেই এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে হাওরের বাঁধগুলো জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতো। প্রধানত পৌষ মাসে ধান চাষ করে মাঘ মাসেই তারা বাঁধগুলো বেঁধে ফেলতো। প্রতিটি গ্রামের ছেলেবুড়ো সকলে মিলে দল বেঁধে এসব বাঁধ বেঁধে রাখতো। স্বাধীনতার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড এইসব বাঁধের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

অনেক আগে থেকেই হাওরবাসীদের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত। কালের বিবর্তনে স্বর্ণ প্রসবিনী ভাটির এই জনপদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি বৈশ্বিক উষ্ণতায় পরিবেশগত সংকট দেখা দিয়েছে। জেলার ‘হাওরভিত্তিক অর্থনীতি’ এখন বিপর্যস্ত। দিনে দিনে জলবায়ু সংকট তীব্র হচ্ছে। বর্ষায় উজান থেকে পলি, বালি নেমে নদী, খাল কৃষি জমি ভরাট হচ্ছে। মাছের অভয়াশ্রম ধ্বংস হচ্ছে। নদী ভাঙন তীব্র হচ্ছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, প্রথমত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ এলাকার মানুষদের কৃষি বহির্ভূত কর্মসংস্থানের পথে আয় করার জন্য অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান এবং পণ্য উত্পাদনের পর তা বাজারজাত করণের সুবিধা প্রদান— এইটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এছাড়া, হাওর অঞ্চলের প্রধান আয়ের পথ হচ্ছে মাছ ধরা। ফলে এ ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করা। তবে এসব কার্যক্রম সরকার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে সহ-ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে করতে পারলে সেটা বেশি কার্যকরী হবে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, হাওর অঞ্চলের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। তা না হলে সুষম উন্নয়ন হবে না।

সম্ভাবনাময় হাওর, অথচ ...

হাওরগুলোকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্পাদনশীল জলাভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্যাপক জীববৈচিত্র্য ধারণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে হাওরের গুরুত্ব অপরিসীম। স্থায়ী ও অতিথি পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে হাওরগুলো সুপরিচিত। বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর হাওরে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ছোট মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি যেমন মেলে তেমনি গো-চারণভূমি জেগে ওঠে। এখন অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের কারণেও হাওরগুলো হুমকির মুখোমুখি। মাটি ভরাট করে হাওরে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি, হাওরের প্রান্তিকভূমিতে সমপ্রসারিত হচ্ছে বোরো চাষ, কেটে ফেলা হচ্ছে হাওরের বৃক্ষরাজি, সেইসঙ্গে বিলুপ্তি ঘটছে প্রাণিজগতের।

হাওর বলতে আমরা বুঝি সিলেটের চার জেলা ও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একাংশ। মোট ৭টি জেলার ৪৮টি উপজেলার ২ কোটি মানুষ হাওরে বসবাস করে। এর মধ্যে ২০ লাখ একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। মাছ ও কৃষির উপর নির্ভরশীল এই মানুষদের জন্য কোনো সরকারই কর্মসংস্থানের দিকে সেভাবে নজর দেয়নি। এলাকার ২৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ মানুষের জমি নাই।
উদাম পাহাড় ধুয়ে লাখ টন পলি নামছে প্রতিবছর
বন্যায় একদিকে হাওরে পানি বাড়তো অন্যদিকে কৃষক ধান কেটে গোলায় তুলে নিতে সময় পেতেন। অথবা বান ডাকলে কৃষক নিজেই কাস্তে কোদাল আর টুকরি নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করে ঢলের পানি আটকে দিতেন। তখন বন্যার প্রকোপটা ছিল অনেকটা সহনশীল পর্যায়ে। এর অনেক কারণ রয়েছে। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশ অসংখ্য নদী-খাল জলাভূমিবেষ্টিত ছিল।

http://www.ittefaq.com.bd/wholecountry/2017/04/29/112203.html