২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৪৭

জটিল করব্যবস্থা

তামাকের করাল গ্রাস-৪

সিগারেটের ওপর করারোপ করা হয় তিনটি স্তরে ভাগ করে। বিড়ির ক্ষেত্রে এটি নির্ধারণ করা হয় ট্যারিপ ভ্যালুর ওপর। আর এক্স-ফ্যাক্টরি মূল্যের ওপর কর নির্ধারণ করা হয় গুল-জর্দার ক্ষেত্রে। এনবিআরের বিধানটি এতটাই জটিল, আইন সম্পর্কে ভালো জানাশোনা না থাকলে কারো পক্ষে এমন জটিল বিধান আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। অভিযোগ রয়েছে, স্বয়ং রাজস্ব কর্মকর্তারাও ঠিক মতো বোঝেন না আইনটি। জীবনবিনাশী তামাকের একেক পণ্যে একেক ভিত্তিতে করারোপের ফলে মূলত কর ফাঁকিবাজরাই লাভবান হচ্ছেন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তাদের অভিযোগ, এর মাধ্যমে এক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে তা থেকে সুযোগ নিচ্ছেন সুবিধাবাদীরা। অথচ পরিকল্পিত হারে করারোপ করা হলে ক্ষতিকারক এসব পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বর্তমানের অন্তত দেড়গুণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, সিগারেটের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ, বিড়ির ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং গুল-জর্দার ক্ষেত্রে শতভাগ সুনির্দিষ্ট শুল্ক বিদ্যমান আছে। পাশাপাশি রয়েছে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং এক শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ। এর বাইরে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ৪০ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত না হলে ৪৫ শতাংশ করপোরেট আয়কর দিতে হয়। তামাকের ব্যবহারজনিত কারণে দেশে প্রতি বছর অন্তত ৯৬ হাজার মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে সচেতন জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তামাকপণ্যে আরো করারোপের দাবি উঠলেও সরকার ভ্রুক্ষেপ করছে না। অবশ্য শুল্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে পদাধিকারবলে বিএটির পরিচালক হওয়া ছয় আমলার চাপ, তামাক কোম্পানিগুলো অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং নানামুখী প্রভাবকেও এর জন্য দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা।
শুভঙ্করের ফাঁকি : জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনের পর সচেতন মহলের পক্ষ থেকে প্রতি বছরই তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। দাবি করা হয় বাড়তি শুল্ক-কর আরোপের। সরকারের পক্ষ থেকে হিসাব কষে দেখানো হয় বাড়তি করারোপের বিষয়টি। অথচ এ বাড়তি করারোপের মধ্যেই রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। কারণ দেশে জর্দা-গুলের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের সাথে সব ধরনের লাভ ধরে এক্স-ফ্যাক্টরি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। শুল্ক আরোপ করা হয় তার ওপর। এতে করে শুল্ক যতোই বাড়ানো হোক না কেন উৎপাদনকারী বরাবরই লাভে থাকেন। রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রয়োজনে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়া হলে লাভ আরো বেড়ে যায়। অর্থাৎ সরকারের উদ্যোগ তামাকপণ্য উৎপাদনকারী ও ভোক্তাদের নিরুৎসাহের পরিবর্তে উৎসাহিত করে।
তামাকপণ্যে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট শুল্ক (এসডি) আরোপের কথা বলা হলেও আইনে বলা আছে, ৩০০ শতাংশ এসডি আরোপের কথা। সেখান থেকে বিশেষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো ২৩৫ থেকে ২৭৫ শতাংশ পর্যন্ত দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিড়ির ক্ষেত্রে যেখানে ৩০০ শতাংশ এসডি আইনগতভাবে আরোপিত সেখানে তাদের ২৭৫ শতাংশ দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। সিগারেটের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি ২৩৭ থেকে ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত। সরকারের এমন অবস্থানকে তামাকপণ্যের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্বমূলক বলে দাবি করেছেন বিশ্লেষকেরা। যদিও যৌক্তিক কারণেই বিষয়টি দীর্ঘ দিন ধরে এভাবে চর্চা হয়ে আসছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ : ২০১৪ সালে পরিচালিত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি জরিপে দেখা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। কম দামি তামাকের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। আমাদের নিচে অবস্থান করছে কেবল মিয়ানমার ও নেপাল। এ দেশে এখনো দুই টাকায় এক কৌটা গুল পাওয়া যায়। পাঁচ টাকায় পাওয়া যায় ৫০ গ্রাম জর্দা। ৩০ পয়সায় বিড়ি মেলে, সিগারেট পান করা যায় মাত্র দুই টাকা খরচ করে। পরিবেশ আইন উপেক্ষা করে মাইলের পর মাইল জমিতে তামাক চাষ করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। গরিব মানুষের বসতবাড়ির আশপাশেই প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে তামাক পাতা। বিড়ি, জর্দা, গুল তৈরি ও প্যাকেটজাতকরণে নিয়োজিত রাখা হয়েছে কয়েক লাখ শিশুশ্রমিক ও গর্ভবতী নারী। মূলত সস্তা শ্রমের কারণেই এটি সম্ভব হচ্ছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়তি এবং সুনির্দিষ্ট হারে করারোপের মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার কমিয়েও বেশি পরিমাণে কর আদায় করা সম্ভব।
জীবন বাঁচাতে, রাজস্ব বাড়াতে : বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনবিনাশি তামাকের ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো। তাদের মতে, উচ্চমূল্য তরুণদের তামাক ব্যবহার শুধু নিরুৎসাহিত করে না বরং ব্যবহারকারীকে তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশে বর্তমান তামাক কর কাঠামো পরিবর্তন করে সিগারেটের খুচরা মূল্যের ৭০ শতাংশ, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ৫০ শতাংশ সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ ট্যাক্স আরোপ এবং বিদ্যমান একাধিক মূল্যস্তরভিত্তিক অ্যাড ভ্যালোরেম কর প্রথা বাতিল ও কর ব্যবধান কমিয়ে একটি সহজ করারোপ পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব দেন বিশ্লেষকেরা। এমনটি করা হলে প্র্রায় ৯০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান (সিগারেট ও বিড়ি) ছেড়ে দেবে, ৭০ লাখেরও অধিক তরুণ ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত থাকবে, ধূমপানের কারণে সংগঠিত ৬০ লাখের বেশি অকাল মৃত্যু রোধ করা যাবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে আট হাজার কোটি টাকা।
যৌক্তিক করপ্রস্তাব : আসন্ন ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে তামাকপণ্যের ওপর করারোপের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিয়েছে গবেষণা সংস্থা প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা)। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছেÑ প্রতি ১০ শলাকা নি¤œস্তরের সিগারেটে ২৫.৯৫ টাকা, উচ্চস্তরের সিগারেটে ৪৯.৬০ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটে ৮২ টাকা সুনির্দিষ্ট কর ধার্য করা। নি¤œস্তরের সিগারেটের খুচরামূল্য ২৩ টাকার স্থলে কমপক্ষে ৪০ টাকা, উচ্চস্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭০ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য কমপক্ষে ১২০ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয় প্রজ্ঞা। এর ফলে সিগারেট থেকে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব (সুনির্দিষ্ট কর এবং ভ্যাট) আয় হবে এবং একই সাথে সিগারেটের ব্যবহার কমবে বলে সংস্থাটির গবেষণালব্ধ আশাবাদ। প্রজ্ঞার মতে, প্রতি ২৫ শলাকা বিড়ির ওপর ১০.১৩ টাকা সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ কর আরোপ করে বিড়ির খুচরা মূল্য ১০.৬১ টাকার স্থলে ২২.৩০ টাকা নির্ধারণ করা উচিত। এর ফলে বিড়ির ব্যবহার কমবে অথচ বিড়ি থেকে অতিরিক্ত এক হাজার ৩০ কোটি টাকা আয় হবে। এ ছাড়া প্রতি ২০ গ্রাম ওজনের জর্দা ও গুলে ১৬ টাকা সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ করারোপ করে এসআরো এর মাধ্যমে এর খুচরা মূল্য কমপক্ষে ৩২ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি।
বাড়তি করারোপে অনীহার নেপথ্যে : তবে তামাকপণ্যে অধিক করারোপে অনীহার পেছনেও যুক্তি আছে বলে দাবি করেছেন এনবিআরের যুগ্ম কমিশনার মো: মাহবুবুর রহমান। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে জনমতের সাথে এনবিআরের কর্মকর্তারাও একমত। তবে আমরা চাই না ঢালাও করারোপের মাধ্যমে দেশী কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাক, লাভবান হোক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
তিনি বলেন, দামি সিগারেটের ওপর বর্তমানে ৬৫ শতাংশ সুনির্দিষ্ট শুল্ক (এসডি), ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং এক শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপিত আছে। কোম্পানির লাভের ওপর ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স তো আছেই। বিক্রয় মূল্যর ওপর এসব শুল্ক আরোপের ফলে এ হারে চূড়ান্তরূপে ৮৬ শতাংশ দাঁড়ায়।
এনবিআরের এ কর্মকর্তার দাবি, ৬৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭০ শতাংশ এসডি আরোপ করা হলে চূড়ান্তভাবে শুল্ক দাঁড়াবে প্রায় ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকায় যে সিগারেট বিক্রি হবে তাতে সরকার পাবে ৯২ টাকা এবং বাকি ৮ টাকা পাবে উৎপাদনকারী এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা। সরকার এ কাজটি কখনোই করবে না। কারণ, বাজার তখন বিদেশী সিগারেটের দখলে চলে যাবে। অন্য দিকে কম দামি অর্থাৎ দেশী কোম্পানিগুলো কর্তৃক উৎপাদিত সিগারেটের ওপর অধিক হারে করারোপ করা হলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এবং লাভবান হবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। তবে স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কথা বিবেচনা করে গুল, জর্দা, বিড়ি এবং নি¤œমানের সিগারেটের ওপর আরো অধিক হারে শুল্ক আরোপের সুযোগ আছে বলে জানান মাহবুবুর রহমান।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/215762