২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৯:৩১

আন্তর্জাতিক টেন্ডারের শর্ত নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের আপত্তি

সচিবের চাপের মুখে প্রাথমিকের বই ছাপার টেন্ডার পেছাল

আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) আহূত টেন্ডারের শর্ত নিয়ে আপত্তি তুলেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আপত্তি জানিয়েছে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতিও। তাদের আপত্তির মুখে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার জন্য আহূত টেন্ডার খোলার তারিখ ১৫ দিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ টেন্ডার খোলার কথা ছিল। এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে টেন্ডারের শর্ত সংশোধনের লক্ষ্যে টেন্ডার খোলার তারিখ পেছানো হয়েছে। এতে সময়মতো বই পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
মন্ত্রণালয়ের আপত্তি নিয়ে গত ২৪ এপ্রিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আসিফ-উজ-জামানের সাথে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানসহ বোর্ড সদস্যদের দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার জন্য এনসিটিবির আহূত টেন্ডারের শর্ত নিয়ে ঘোর আপত্তি তুলেছেন সচিব। তিনি উক্ত টেন্ডারের শর্তগুলোতে কেন দেশীয় স্বার্থ ও দেশীয় মুদ্রণকারদের প্রাধান্য দেয়া হয়নি এবং তাদের দাবির ব্যাপারে কেন গতকাল পর্যন্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি তা জানতে চান। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব চলতি বছরের টেন্ডারের শর্তানুসারে বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় মুদ্রণকারীদের ব্যর্থতা, সময়মতো বই সরবরাহ না করা এবং বইয়ের মান নিয়ে এনসিটিবি কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানতে চান।
জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যরা বারবারই বিশ্বব্যাংকের দোহাই দিয়ে পাশ কাটাতে চান বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। সচিব আগামী বছরের টেন্ডারের শর্ত নিয়েও আপত্তি তোলেন। তিনি বোর্ডকে (এনসিটিবিকে) নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক টেন্ডারের ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের বৈষম্য না ঘটে এবং দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকদের আপত্তিকে বিবেচনায় নিয়ে আহূত টেন্ডারের শর্ত পুনঃপর্যালোচনা করে প্রয়োজনে পুনঃটেন্ডার আহ্বান করার কথা বলেন। পরে এনসিটিবির কর্মকর্তারা টেন্ডারের শর্তগুলো পর্যালোচনা করে টেন্ডার খোলার তারিখ পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করলে সচিব তাতে সম্মতি জানান। বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছে টেন্ডার খোলার সময় ১৫ দিন পিছিয়ে দেয়া হবে এবং টেন্ডারের শর্তগুলো সংশোধন করে নোটিশ ইস্যু করা হবে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক আবদুল মজিদ (উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রক)-র কক্ষে গিয়ে প্রাথমিকের টেন্ডার নিয়ে বৈঠক করেন বলে জানা গেছে। এ নিয়ে এনসিটিবির অন্য সদস্যদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অসন্তোষের কারণ সম্পর্কে সূত্র জানায়, বোর্ডের একসাথে তিনটি পদে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক আবদুল মজিদ (উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রক)-র হাতে বোর্ড সদস্যরা এবং চেয়ারম্যানও অনেকটাই জিম্মি। দীর্ঘ দিন বোর্ডের উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রক পদে থাকা কর্মকর্তারাই বারবার বিশ্বব্যাংকের দোহাই দিয়ে বিদেশী মুদ্রণকারীদের স্বার্থে কাজ করেন। এ কর্মকর্তা এখন বিতরণ ও নিয়ন্ত্রক এবং (কারিকুলাম প্রাথমিক)-র দায়িত্বও বাগিয়ে-নেয়ার পাঁয়তারা করছেন। বোর্ডের একাধিক সদস্য ছাড়াও একজন প্রভাবশালী দেশীয় মুদ্রাকর ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রাথমিকের টেন্ডারের শর্ত নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে তাতে, কাগজের নমুনা, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল, দেশী ও বিদেশী মুদ্রাকরদের কার্যাদেশের সময় নিয়ে বৈষম্য, বিদেশীদের এজেন্টের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়াসহ নানা বিষয় আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কিছু জানা যায়নি।
এদিকে এনসিটিবি গতকাল পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মাধ্যমিকের জন্য ২২০ লটের বই ছাপা কাজের জন্য, যারা টেন্ডারে অংশ নিয়েছেন তাদের যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য। এসব তদন্ত কমিটি দেশীয় মুদ্রাকরদের ভৌত অবকাঠামো সরেজমিন পরিদর্শন করে বোর্ডকে প্রতিবেদন দেবে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই মাধ্যমিকের বই ছাপার টেন্ডারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। উল্লেখ্য, গত ২০ এপ্রিল মাধ্যমিকের ২২০ লটের টেন্ডার খোলা হয়েছে। তাতে দেশীয় সাড়ে পাঁচশ’ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে। এখানে বিদেশী মুদ্রণকারীদের কোনো সুযোগ নেই।
জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে দেশীয় যেসব প্রতিষ্ঠান সময়মতো বই দিতে পারেনি, তারাও আবার টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। দেশী-বিদেশী ব্যর্থ এসব প্রতিষ্ঠান আবারো বই ছাপার আদেশ পেতে যাচ্ছে। ফলে আবারো সময়মতো ও মানসম্পন্ন বিনামূল্যের পাঠ্যবই প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/215211