২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৯:২৭

ন্যায্যমূল্যের দোকানে ফসলহারা মানুষের লাইন

অনেকেই ফিরেছেন খালি হাতে : ত্রাণের তালিকা নিয়ে অসন্তোষ

সুনামগঞ্জে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর জন্য খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল-আটা বিক্রি শুরু হয়েছে। দোকানের সংখ্যা কম থাকায় মানুষকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ খালি হাতে ফিরছেন। ত্রাণের তালিকা নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যেখানে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেখানে কম বরাদ্দ এবং যেখানে কম ক্ষতি সেখানে বেশি বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়।
২৬ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলায় তিনটি করে এবং জেলা সদরে ৯টি দোকানের অনুমতি দিয়েছে খাদ্য বিভাগ। এসব দোকানে দিনে এক হাজার কেজি চাল ও এক হাজার কেজি আটা বিক্রি হবে।
চাল বা আটা সংগ্রহ করতে অনেকেই ১০-১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসছেন। লাইনে দাঁড়ানো কারও কোলে সদ্যোজাত শিশুসন্তান, কেউ আবার বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বাজারের চেয়ে কম দামে ৫ কেজি চাল কিনে বাড়ি ফিরতে চাইছেন সবাই। এ জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। কিন্তু বরাদ্দ কম হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই অর্ধেকেরও বেশি মানুষ চাল-আটা ছাড়াই শূন্যহাতে বাড়ি ফিরছেন। সকাল ৯টায় এক টন চাল বণ্টন শুরু হলে ১২টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। দীর্ঘ লাইনের অর্ধেক মানুষও এ চাল পান না। চাল-আটা সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অনেককে ঝগড়া করতে দেখা গেছে। জেলায় খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি এর আগে দেখা যায়নি বলে অনেকেই জানান। এ অবস্থাকে হাওরে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার পূর্বাভাস বলে মনে করছেন অনেকেই। এ জন্য তারা কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার দাবি জানান। তারা বলেন, আগামী বোরো ফসল ওঠার আগ পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনে ব্যাপক সহায়তা দিতে হবে।
সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের গৃহিণী রুবিনা বেগম বলেন, ‘২২ দিনের শিশুকে লগে লইয়া ন্যায্যমূল্যের দোকানো পাঁচ কেজি চাউল কিনতাম আইছি। বিয়ানিবালা আইছিলাম অনে দুপুর অইলেও শেষ পর্যন্ত পাইমু কিনা জানি না।’
জলিলপুর গ্রামের আইরুন নেছা বলেন, ‘বাজারে চাউলের যে দাম এই দামে কিনার সামর্থ্য নাই। এর লাগি লাইনে দাঁড়াইয়া মানুষের ঠেলাঠেলি সহ্য কইরা চাউল কিনতাম আইছি। এর আগেও দু’দিন আইয়া না ফাইয়া ঘুইরা গেছি। জানি না আইজ কপালো ঝুটব কিনা। সকাল থাইক্ক্যা লাইনে দাঁড়াই আছি। মানুষের ঠেলায় জান বারইজার। টেখা দিয়া লাইন ধইর্যা চাউল ফাইলাম না। বেহুদা কষ্ট করলাম আধা দিন।’
সদর উপজেলার ভাদুরপুর গ্রামের রফিকুন্নেছা আক্ষেপ করে বলেন, ‘তিন দিন লাইনে দাঁড়িয়ে চাল নিতে পারিনি। আজও খালি হাতে ফিরত জায়রাম।’
৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে সদর উপজেলার হালুয়ারগাঁও থেকে আসা মিমছান বিবি বলেন, ‘চাউল নিতে ভোর ৫টায় আইছিলাম আনা খাইয়া। বাড়ির সব উফাস। চাল লইয়া গেলে ভাত খাইতাম। কিন্তু আজকেও চাল না পাইয়া খালি হাতে জায়রাম।’
সুনামগঞ্জের হাওরের ৯০ ভাগেরও বেশি ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জেলায় প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল। ফসল তলিয়ে যাওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে তিন লাখেরও বেশি কৃষক পরিবার।
এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের যে সহায়তা দেয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ পর্যন্ত সরকারের জেনারেল রিলিফ (জিআর) ফান্ড থেকে ১১ উপজেলায় এক হাজার টন চাল, নগদ ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১৫৫ বান্ডেল ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য জেলায় দেড় লাখ পরিবারকে আগামী তিন মাস ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫০০ টাকা সহায়তা প্রদানের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার সে বিষয়ে উপকারভোগীদের তালিকা প্রণয়নে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাধান্য না দিয়ে উপজেলা ওয়ারি জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যা নির্ধারণ করে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চাহিদা পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তালিকায় দেখা যায়, জনসংখ্যা বেশি থাকায় সর্বনিন্ম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এমন উপজেলায় সহায়তা প্রদানের সর্বোচ্চ প্রস্তাব করা হয়েছে। ছাতক উপজেলায় ৩৬১০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেলেও এ উপজেলায় সরকারি সহায়তা পাবে ২২ হাজার পরিবার। অপরদিকে শতভাগ বোরোনির্ভর শাল্লা উপজেলায় ১৫১১৫ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেলেও ওই উপজেলায় সরকারি সহায়তা পাবে মাত্র ৮ হাজার পরিবার। জনসংখ্যার অনুপাতে দেড় লাখ মানুষের এই তালিকা করা হয়েছে জেলার ১১টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভার জন্য।
এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সুনামগঞ্জে অবস্থানরত ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ফয়েজুর রহমান বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিলেও তিনি জানান, কৃষি বিভাগ থেকে তথ্য নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় এনে এ তালিকা করা হয়েছে। এটি আপাতত পরিবর্তন করা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ভালো বলতে পারবেন।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/26/120247/