২৫ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:০৮

আগাম বন্যায় বড় ক্ষতি

বোরোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা * ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা * স্বাভাবিকের চেয়ে ১১৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত

অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরগুলো ডুবে গেছে। এতে ধান-মাছসহ তিন খাতে ক্ষতি হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া দুর্গত এলাকায় অন্যান্য ফসল, শাকসবজি, ফলমূল, গবাদি পশুসহ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯০ শতাংশ। এতে দেশে বোরোর উৎপাদনের টার্গেট পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। হাওর অঞ্চলের ক্ষতি মোট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর প্রভাব পড়বে না।
ওদিকে হাওর এলাকার সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে সরকার। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পরবর্তী ফসল ঘরে না আসা পর্যন্ত হাওর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত তিন লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা দেবে সরকার। পাশাপাশি থাকবে নানা প্রণোদনা। দেশের হাওর অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কৃষিঋণ আদায় স্থগিত করা হয়েছে সোমবার।
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, হাওর অঞ্চলের ক্ষতি আমাদের বোরো সংগ্রহে এর তেমন প্রভাব পড়বে না। বাজারেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না। এবার বোরোর উৎপাদন বেশি হওয়ায় হাওর এলাকায় বোরোর কিছু ক্ষতি হলেও তা পূরণ হয়ে যাবে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব, কোনো অসুবিধা হবে না।
হাওরের আগাম বন্যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি করেছে বলে জানিয়েছে হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম। সংগঠনটির সদস্য সচিব আনিসুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, হাওরে কাজ করার ক্ষেত্রে তার প্রায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি এবারের মতো এত বড় বিপর্যয় আগে দেখেননি। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে তারা যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে। তবে সরকারের কাছ নেয়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে করা হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বন্যায় নষ্ট হওয়া ১০ লাখ টন চাল, ২ হাজার টন মাছ ও ১১ হাজার ৩০৫ টন গো-খাদ্যের বাজারমূল্য ধরে এ হিসাব বের করেছেন তারা।
জানা গেছে, এপ্রিলের শুরুতেই ভারতের আসামে অতিবৃষ্টির পানি নেমে আসে ভাটিতে। ফলে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় দেখা দেয় আগাম বন্যা। ওই বন্যার পানি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরগুলোকে প্লাবিত করে। হাওর প্লাবিত হওয়ার পেছনে বাঁধ মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি বা দুর্নীতি দায়ী কিনা- এমন প্রশ্নে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি হওয়ায় এ প্লাবন হয়েছে। বর্তমানে বাঁধের উচ্চতা সাড়ে ছয় মিটার। কিন্তু পানির উচ্চতা ছিল ৮ দশমিক ১ মিটার। ফলে বর্তমান বাঁধগুলো উপচে পানি ঢুকছে হাওরে।
পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণেই আগাম বন্যা হয়েছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ একেএম রুহুল কুদ্দুছ যুগান্তরকে বলেন, এ মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে ১১৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। রোববার পর্যন্ত এর পরিমাণ ৮ হাজার ৯০৪ মিলিমিটার। যার স্বাভাবিক পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩ মিলিমিটার। ফলে সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গত বছর এপ্রিলে বলতে গেলে এ সময় তেমন বৃষ্টিই হয়নি। ১ মে’র পর মূলত ওই মৌসুমের বৃষ্টি শুরু হয়েছিল।
ওদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, চলতি বোরো মৌসুমে সারা দেশে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৯১ লাখ ৫৩ হাজার টন। কিন্তু এর মধ্যে ছয় জেলার হাওরের দুই লাখ হেক্টরের বেশি জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার জমি থেকে এবার এক ছটাক ধানও পাওয়া যাবে না। ফলে কমপক্ষে আট লাখ টন ধান কম উৎপাদন হবে, যা উৎপাদনের মোট লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা শঙ্কা প্রকাশ করেন। হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী ধানে মোট ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৩৯১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সিলেটে ৪৫০, সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৯৬৫, হবিগঞ্জে ৬৬১, নেত্রকোনা ৪৬৩, মৌলভীবাজার ২৪৬, কিশোরগঞ্জ ৬০০ এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায় ৪ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, গত বছর ১ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার টন। অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় মশুর, খেসারি, মরিচসহ নানা ধরনের রবিশস্য পানিতে নষ্ট হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বন্যায় দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যেখান থেকে ছয় লাখ টন চাল পাওয়া যেত। তবে এতে আমাদের খাদ্য ঘাটতি হবে না। কারণ দেশের অন্য অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন বেশি হয়েছে। এছাড়া হাওর এলাকার কৃষিঋণ মওকুফসহ আউশ ও আমন চাষে কৃষককে প্রণোদনা দেয়া হবে।
মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাওরের পানিদূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। এছাড়া মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস। পানিতে অক্সিজেন একেবারেই কমে যাওয়ায় এবং অ্যামোনিয়া ও অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ মারা গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব তৈরি করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, হাওর এলাকায় ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ৬টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫টি ঘরবাড়ি পরিপূর্ণ ও আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, হাওরের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়নি যে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। পরিস্থিতি এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। পরিস্থিতি মোকাবেলার সামর্থ্য সরকারের রয়েছে। এজন্য এরই মধ্যে ৩৫ হাজার টন চাল ও ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পরবর্তী ফসল ঘরে না আসা পর্যন্ত হাওর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা দেবে সরকার। এর পাশাপাশি যারা ত্রাণ নেবেন না তাদের জন্য ১৫ টাকা কেজি দরে চাল ও ১০ টাকা কেজি দরে নায্যমূল্যে চাল বিক্রি অব্যাহত থাকবে।
হাওরের সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘হাওর এলাকার সমস্যা চিহ্নিত ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর (পানিসম্পদ, খাদ্য, স্থানীয় সরকার, অর্থ, মৎস্য, তথ্য মন্ত্রণালয়) প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও বন্যার কারণ নির্ধারণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন। এ সময় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষকে খাদ্য এবং অন্যান্য সহায়তা দেয়া হবে। যতদিন পর্যন্ত পানি না সরবে, মানুষ ঘরে ফিরে না যাবে, যতদিন পর্যন্ত পরবর্তী ফসল না উঠবে, তত দিন এ সহায়তা দেয়া হবে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/25/119987/