২৫ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৯

ভারতীয় বিষাক্ত বর্জ্যরে ভাগাড়

চলতে ফিরতে দেখা

|| ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ||

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অতি মাত্রায় ভারত তোষণ আর নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ এক দিকে যেমন ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, অপর দিকে তেমনি ভারত তার নিজের স্বার্থে বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রকৃতি, কৃষি, জীবনযাত্রা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির রূপ বদলে দিচ্ছে। কার্যত বাংলাদেশকে ভারতায়ন করার এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। কত দিকে কত কায়দায় এটা ঘটছে, তা এখন আর বর্ণনা করা যায় না। কার্যত এই আগ্রাসনের ফলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ দেশের নদ-নদীগুলোই আমাদের প্রাণ এবং আমাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি নির্মিত হয়েছে এসব নদ-নদী ঘিরেই। ভারত একে একে এসব নদ-নদীর টুঁটি চেপে হত্যা করছে। ইতোমধ্যে অভিন্ন ৫৪টি অভিন্ন নদীর গতিপথ তারা রুদ্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশে মরুকরণ সৃষ্টি করেছে। ফলে আমাদের তরুণসমাজ এক সময় ভুলেই যাবে যে, সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা ছিল এই বাংলাদেশ। তারা হয়তো জানতে শিখবে, বাংলাদেশ ভারতের রাজস্থানের মতো মরুভূমিই ছিল।
সর্বশেষ জনপ্রতিনিধিত্বহীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে সবাই আশা করেছিল, তিস্তায় কিছু পানি পাওয়া যাবে। এই অভিন্ন নদীর পানিও ভারত সম্পূর্ণরূপে আটকে দিয়েছে ২০১২ সাল থেকে। সরকার ভারতের নির্লজ্জ দালালি করতে গিয়ে ভুলেই গেছে, তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানি দেয়া ভারতের মর্জির ওপর নির্ভর করে না। এটা ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের অধিকার। এসব নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের দিতে ভারত বাধ্য। শেখ হাসিনা দিল্লি গিয়ে সম্ভবত ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে ভারত সরকারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের কিছু পানি দাও। পানি মেলেনি। এ নিয়ে কৌতুক করে তিনি হিন্দি ভাষায় বলেছিলেন, পানি চেয়েছিলাম, বিদ্যুৎ পেলাম। ভালোই হলো। কিছু তো পেলাম। যেন ভিখারির থালায় কেউ ছুড়ে দিলো দু-একটি ফুটো মুদ্রা। এরপর তিনি তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী আগের সরকারগুলো বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে কষে গাল দিলেন। বললেন, তিনি তো কোনো দিন পানির জন্য একটি কথাও বললেন না। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যটি সত্য নয়। পানির প্রবাহ আগেও ছিল। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরও তিস্তার পানিপ্রবাহ পাঁচ হাজার কিউসেকের ওপরে ছিল। তার ক্ষমতাকালেই ২০১১ সালেও তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল তিন থেকে পাঁচ হাজার কিউসেকের ওপরে। তার পর থেকে তিস্তার পানি একেবারে শুকিয়ে গেল যে, বাংলাদেশকে এক ফোঁটা পানিও দেয়া যাবে না।
দিল্লির সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির যুক্তি দেখায়। মমতা পানি দিতে চান না, তাই দিল্লি পানি দিতে পারছে না। এটা ছেলেভুলানো কথা মাত্র। কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তি করলে রাজ্য সরকার তা মানতে বাধ্য। মমতা চাইছেন, পানি চুক্তির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর দিয়ে যাক। আর দিল্লি চাইছে, তার নিজ দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের বশংবদ সরকারকে পানি না দিলেও কোনো ক্ষতি নেই। তাদের কিছু করার মুরোদ নেই। সেই কিছুটা হলো, পানির জন্য জাতিসঙ্ঘের কাছে যাওয়া। ফারাক্কার পানি নিয়ে ভারত যখন এ রকম টালবাহানা শুরু করেছিল, তখন জিয়াউর রহমান এই ইস্যু নিয়ে জাতিসঙ্ঘে গিয়েছিলেন এবং ভারত একটা সম্মানজনক মীমাংসা করতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ অধিকার আদায়ের জন্য বর্তমান সরকার ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
ভারতের বাতিল মাল ওই দেশ তার আশপাশের দেশে সব সময় গছিয়ে দিতে চায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের জন্য আদর্শ জায়গা। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাও জায়গা বটে; তবে ওই সব দেশ শেষ পর্যন্ত তাদের আত্মমর্যাদার প্রমাণ দিয়ে নিজেদের অনেকখানি রক্ষা করতে পেরেছে। এর একটি হলো ভারতের ৮০০ সিসি মারুতি-সুজুকি ট্যাক্সি। বহুল ব্যবহার শেষে যখন এগুলো আর চলাচলের উপযুক্ত থাকে না, তখন সামান্য মেরামত করে রঙচঙ দিয়ে সেগুলো নতুন বলে ভারত বাংলাদেশসহ তার আশপাশের দেশে রফতানি করেছে। ছয় মাস-এক বছর কোনো মতে জোড়াতালি দিয়ে ব্যবহারের পর এগুলো বাতিল আবর্জনায় পরিণত হয়েছে এবং ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি হয়েছে। ঢাকায় এ ধরনের বহু কালো ও নীল ভারতীয় বাতিল ট্যাক্সির আমদানি হয়েছিল। সেগুলোর সবই মালিকদের পথে বসিয়ে এক বছরের মধ্যে ডাম্পিংয়ে চলে গেছে। এখন তার একটিও কোথাও দেখা যায় না। ভুটানেও টয়োটা গাড়ির প্রাধান্য বেশি। ভুক্তভোগী নেপালও এখন টয়োটার দিকেই বেশি জোর দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কা আরো অনেক বেশি কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা ভারতীয় এসব ডাম্পিং গাড়ির ওপর দ্বিগুণ শুল্ক আরোপ করে এর আমদানি অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। শুধু বাংলাদেশের সীমান্তই খোলা। এই সীমান্ত দিয়ে ভারত বাংলাদেশে অস্ত্র, মাদক সবই অবাধে পাঠাচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি আন্দোলন বাংলাদেশে হয়েছে ও হচ্ছে সুন্দরবনের ১২ কিলোমিটারের মধ্যে ভারতের সহযোগিতায় কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে। এই প্রকল্প গ্রহণের পর থেকেই দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো একযোগে রামপালবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। পরিবেশবাদীদের বক্তব্য হলো, তারা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধী নন। কিন্তু সুন্দরবনের এত কাছে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে বনের ভয়াবহ ক্ষতি হবে। আর বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে ও তার আওয়ামী নেতারা অবিরাম বলে যাচ্ছেন, যারা এসব কথা বলছেন, তারা নিতান্তই মূর্খ। তাদের সুন্দরবন ও রামপাল সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। ‘বাবু যত বলে পারিষদ দল বলে তার শতগুণ’। আর এসব বিতর্কের মধ্যেই সুন্দরবনের ভেতরে ডুবে যায় একটি তেলবাহী ও একটি কয়লাবাহী কার্গো। তাতে বনের জলজ প্রাণী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতিসঙ্ঘ, ইউনেস্কো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানও বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে তদন্ত করে বলেছে, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প না করতে। তাতে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে এবং বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। তা ছাড়া এটা রামসার চুক্তিরও বিরোধী। বাংলাদেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু সরকার এসব কথায় কান দিচ্ছে না।
ঘটনার রহস্য লুকিয়ে আছে অন্যত্র। এই প্রকল্পে প্রতি বছর ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এই কয়লা পশুর নদী দিয়ে আনতে হবে। তাতে ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার ৫৯টি জাহাজের প্রয়োজন হবে। পরিবেশবিদেরা বলছেন, কয়লাবাহী জাহাজগুলো ঢেকে আনা হয় না। এর ফলে নদীতে ও পরিবেশে বিপুলমাত্রায় ফাই অ্যাশ, কয়লার গুঁড়া, সালফার, কার্বন মনো-অক্সাইড ও অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়বে। যত দিন এই প্রকল্প থাকবে, তত দিনই এই পরিস্থিতি বিরাজ করবে। প্রতিদিন এই প্রকল্পে পুড়বে ১৩ হাজার টন করে কয়লা। তার ছাই ফেলা হবে নদীতে। যার ফলে জলজ প্রাণীর প্রতিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়বে। ভারী কার্গোগুলো চলাচলের ফলে বন্যপ্রাণী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয় হারাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্প থেকে নানা রকম বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হবে। তার মধ্যে রয়েছে কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড। এসব চার পাশে ছড়িয়ে পড়বে এবং সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলবে। এর আগে ভারতের মধ্যপ্রদেশের গজমারায় দিল্লি রামপালের মতো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে দেখা গেল এর ফলে পরিবেশ ও ব্যাপক কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে সরকার এই প্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য হয়। এ ছাড়াও ভারতের পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞায় ভারত অনেক জায়গায়ই কয়লাভিত্তিক প্রকল্প করতে পারেনি। আর সে কারণেই এ ধরনের প্রকল্প তৈরির জন্য ভারত বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। লক্ষণীয় যে, ভুটান কিংবা নেপালে ভারত এ ধরনের প্রকল্প তৈরির প্রস্তাবও কোনো দিন করেনি। বাংলাদেশে একটি নতজানু সরকার আছে বলেই তারা এটা করতে পারছে।
রামপালে ভারতের বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের আরো একটি কারণ তার উদ্বৃত্ত নিম্নমানের অধিক সালফারযুক্ত কয়লার ব্যবহার। দিল্লি সরকার এই কয়লা ভারতে ব্যবহার করতে পারে না। অথচ রামপাল প্রকল্প চালু করতে পারলে এই খাস্তা কয়লার একটা গতি হয়। এর ফলে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হলো, তাতে ভারতের কিছু আসে-যায় না।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের হাওর এলাকায় আকস্মিক বন্যা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলগুলো প্রধানত একফসলি এলাকা। কোথাও কোথাও কিছু রবিশস্যও হয়। বাকি সময় হাওরবাসী জীবিকা নির্বাহ করেন মাছ ধরে। আকস্মিক বন্যা এখানে নতুন কিছু নয়। হাওরের সার-কীটনাশকের ব্যবহারও নতুন নয়। হাওরের পানির নিচে থোড় ধান তলিয়ে থেকে পচে। আমরা এর সাথে পরিচিত। কিন্তু হাওরের জলজ প্রাণী মাছ ও ব্যাঙ কখনো মারা যায়নি। এখন ঝাঁকে ঝাঁকে মরে ভেসে উঠছে হাওরের মাছ, ব্যাঙ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। শুরুতে কেউ কেউ বলছিলেন, ধানের জমিতে অ্যামোনিয়া সারের ব্যবহারের ফলে বিষাক্ত গ্যাস পানিতে তৈরি হয়েছে। আর তার ফলেই মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। হাওর এলাকায় এই সারের ব্যবহারও নতুন নয়। কিন্তু পানিতে ভেসে বেড়ানো হাঁস ওই মাছ খেয়ে যখন মারা যেতে শুরু করল, তখন বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠল। অক্সিজেনের অভাবে মাছ মরল, কিন্তু সেই মাছ খেয়ে হাঁস কেন মারা গেল।
এর আসল কারণ জানা গেল ঢাকার একটি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মেঘালয়ে আছে ভারতের ইউরেনিয়ামের খোলা খনি। সে এলাকা আবার গভীর বনের ভেতরে। সেখানকার খাসিয়া নেতারা শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন, এই খোলা খনিগুলো বন্ধ করে দেয়া হোক। কিন্তু না কোম্পানি, না রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু খাসিয়া নেতা মারকোনি থংনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাদের এলাকার রানীকোর নদীর পানির রঙও বদলে সবুজ ও নীল হয়ে গেছে এবং মাছ ও ব্যাঙ মরে ভেসে উঠছে। ইউরেনিয়ামের প্রভাবেই এটা ঘটছে বলে তিনি দাবি করেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকেই তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি।
তাই যদি হয়, তা হলে হাওরের বিপুল কৃষি ও মৎস্যসম্পদ থেকে আমরা যেমন বঞ্চিত হব, তেমনি কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়বে। ভারত তোষণের জন্য তবু কি সরকার চুপ করেই থাকবে?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/214871