সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করছে : নয়া দিগন্ত
২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৫৮

শনির হাওরের শেষ রক্ষা হলো না

দশ হাজার হেক্টর বোরো ধান ঢলে তলিয়ে গেছে; ৪০ ভাগ কাজও করেননি পাউবোর ঠিকাদার

 

কৃষকের সব স্বপ্ন ভেঙে দিলো পাহাড়ি ঢলের পানি। ভাসিয়ে দিলো তাহিরপুর উপজেলার সর্বশেষ শনির হাওরটিও। দীর্ঘ ২৫ দিন ধরেই ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত উপেক্ষা করে দিন-রাত হাজার হাজার শ্রমিক স্বেচ্ছাশ্রমে হাওরটির বাঁধ রক্ষায় কাজ করছিলেন। বাঁধ দেখভাল করতে রাত জেগে পাহারায় ছিল আরেক দল। একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পরও উপজেলাবাসীর একটাই সর্বশেষ চেষ্টা ছিল শনির হাওর রক্ষা। তাই জীবিকা ধারণের শেষ সম্পদ রক্ষায় রাতদিন পরিশ্রম করে আসছিলেন স্থানীয়রা। নিজেদের জীবনবাজি রেখেই যুদ্ধ করছিল হাওরবাসী হাওরের বাঁধে পাহাড়ি ঢলের পানি আর বৈরী আবহাওয়ার সাথে। কিন্তু উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল নিঃশেষ করে দিলো তাদের স্বপ্ন। এই হাওরটির শেষ রক্ষা করতে না পেরে বুকভড়া দীর্ঘশ্বাসে যেন হাওরপাড়ের আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় গত শনিবার রাতে লালুগোয়লা ও আহমখালি বাঁধে কয়েকটি বুরুংগা বড় (পানি প্রবাহের ছোট ছিদ্র) হয়ে বৃষ্টির পানির চাপে বাঁধ ভেঙে তীব্র গতিতে হাওরে প্রবেশ করেছে পাহাড়ি ঢলের পানি। রাতে হাওরের পাহারায় থাকা লোকজন এ হাওরটি রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।
জানা যায়, বোরো উৎপাদনে সমৃদ্ধ বৃহত্তর এ হাওরে তাহিরপুর উপজেলার সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর ও পাশের জামালগঞ্জ উপজেলার তিন হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে কৃষকেরা বোরো ধানের চাষাবাদ করেছেন। হাওরের ফসল প্লাবিত হওয়ায় হতাশায় ভেঙে গেছে সবার মন। কারণ এই বাঁধ ভাঙার ফলে শনির হাওর রক্ষায় কোনো উপায় থাকল না। খবর পেয়ে বাঁধে ছুটে যান তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ হাওর পাড়ের কৃষকেরা। নিমেষেই হাওর যেন পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠছে পাহাড়ি ঢলের পানিতে।
বাদল, সাইদুল, নাসরুম, সোহাগ, সাদেক আলীসহ স্থানীয় কৃষকেরা জানান, যেভাবে হাওরে পানি ঢুকছে, সন্ধ্যার মধ্যে শনির হাওরের আধা পাকা ও কাঁচা বোরো ধান পানির নিচে ডুবে যাবে। তাই এখন কাটছি কিছু করার নেই। তারা অভিযোগ করে বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই উপজেলার ২৩টি হাওরের ১৮টি বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করার সরকারি নির্দেশ থাকলেও ৪০ শতাংশ কাজও শেষ করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার ও পিআইসিরা। নিজেদের খেয়াল খুশি মতো, দায়সারাভাবে বাঁধ নির্মাণ করায় একের পর এক হাওর ডুবে এ উপজেলার ৯০ শতাংশ বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। বাঁধ রক্ষায় ফাটল ও দেবে যাওয়া অংশে সংস্কারের কাজ করেছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুলসহ হাওর পাড়ের কৃষকরা দিন-রাত স্বেচ্ছাশ্রমে। এই ফসল ফলাতে কৃষকেরা এনজিও, ব্যাংক ও মহাজনের কাছ থেকে সুদে ঋণ নিয়ে রেখেছেন এখন ফসলহানির কারণে ধান পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হাওর পাড়ের কৃষকেরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলায় এ বছর ১৮ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। শনির হাওর ডুবে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার হেক্টর কাঁচা, আধা পাকা বোরো জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া হাওরের কাঁচা ও পাশের জামালগঞ্জ উপজেলার তিন হাজার হেক্টরের বেশি আধা পাকা ধান কাটছেন এখন কৃষকেরা। উপজেলার ছোট-বড় ২৩টি হাওরে উৎপাদিত ২০০ কোটি টাকার ফসলের ওপর নির্ভর করেই জীবন-জীবিকা চলে হাজার হাজার কৃষক পরিবারের। কিন্তু এ বছর ৯০ শতাংশ বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেল।
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুস ছালাম জানান, রাতে খবর আসে শনির হাওরের লালু গোয়ালা বাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে সাড়ে ৯ হাজার হেক্টরের বোরো জমির আধা কাঁচা-পাকা ধান বেশির ভাগ পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এ বছর হাওরের ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণ না করার কারণে একের পর এক হাওর ডুবছে। শনির হাওরের বাঁধটি রক্ষায় হাজার হাজার কৃষক ২৫ দিন ধরে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁধটির শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। লালুরগোয়লা বাঁধ ভেঙে ও সাহেব নগরের উপর দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি এখন শনির হাওরে তীব্রগতিতে ঢুকছে। এবার কৃষকের কষ্টের শেষ নেই। বাঁধ নির্মার্ণে দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি ও কৃষকদের সহযোগিতার দাবি জানাই।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, শনির হাওরের বাঁধ রক্ষায় চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন হাজার শ্রমিক। কিন্তু গত শনিবার রাতে খবর পেলাম লালুরগোয়ালা বাঁধ ভেঙে গেছে। যার ফলে শনির হাওর রক্ষা করা সম্ভব হলো না।
এবার ডুবছে কিশোরগঞ্জের উঁচু এলাকার জমি
মো: আল আমিন কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, হাওরের ফসল ডুবে যাওয়ার পর গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণে এবার তলিয়ে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের উঁচু এলাকার জমি। চোখের সামনে স্বপ্নের ফসল তলিয়ে যেতে দেখে অসহায় কৃষক বুক চাপড়িয়ে কাঁদছেন। গত পাঁচ দিনের টানা বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জের অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত তাড়াইলের দিগদাইড়, দামিহা, ধলা, জাওয়ার ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার তিন হাজার হেক্টর জমির ধান ডুবে গেছে। শুধু ধান নয়, তলিয়ে গেছে এসব এলাকার রবি ফসলও।
গতকাল সরেজমিন দিগদাইড় ও দামিহা ইউনিয়নের কাউড়ার বন্দে গিয়ে দেখা গেছে, হাজার হাজার একর জমির ধানগাছ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকেরা এসব এলাকায় কাঁচা ধান কাটার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে দেন। কাউড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ধান হারানো কৃষক পানিতে ডুবি দিয়ে বাদাম ও মরিচ তোলার চেষ্টা করছেন। গত বুধবার কাউড়ার বাঁধ ভেঙে এ এলাকায় পানি ঢোকে। এলাকার কৃষক ফরিদ উদ্দিন (৬৫) জানান, জীবনে অনেকবার বিভিন্ন দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু অতি বৃষ্টির কারণে আমাদের এলাকায় এভাবে জমি তলিয়ে যেতে এবারই প্রথম দেখলাম। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার উপজেলায় ১০ হাজার ৪০ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ করা হয়েছিল। তার ভাষ্য, অতি বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমে এ ক্ষতি হলো।
গত শনিবার কিশোরগঞ্জের আরেক উপজেলা করিমগঞ্জের গুনধর ইউনিয়নের খয়রত, মদন, উরদিঘী, ভাটি গাঙ্গাটিয়া এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় বড় হাওরের নিচু জমি প্রায় অর্ধেক তলিয়ে গেছে।
এ দিকে গতকাল রোববার বিকেলে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলী, বাজিতপুর, ভৈরব, তাড়াইল ও হোসেনপুর এ ৯টি উপজেলায় আবাদকৃত বোরো জমির পরিমাণ এক লাখ ২৯ হাজার ৩২৬ হেক্টর। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মোট ফসলি বোরো জমির পরিমাণ ৫৭ হাজার ২৭ হেক্টর। ক্ষতির হার ৪৪.০৯%। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মোট কৃষকের সংখ্যা এক লাখ ৩৭ হাজার ২৭৫ জন। ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে চাল উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ ২০১৩০৫ মেট্রিক টন। ৪০ টাকা কেজি দরে যার আর্থিক মূল্য ৮০৫,২২,০০,০০০ টাকা।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/214648