২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৫৩

ক্ষয়ক্ষতির তথ্য–উপাত্ত

হাওরাঞ্চলে ফসলহানি অর্থনীতির বড় ক্ষতি

বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসলহানি জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি করেছে। গতকাল রোববার পর্যন্ত এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। বন্যায় নষ্ট হওয়া ১০ লাখ টন চাল, ২ হাজার মেট্রিক টন মাছ ও ১১ হাজার ৩০৫ টন গোখাদ্যের বাজারমূল্য ধরে এই হিসাব বের করেছে হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম।
হাওর নিয়ে কাজ করা ৩৫টি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ওই সংগঠনটি বলছে, মূলত সরকারি উৎস থেকে নেওয়া তথ্য নিয়ে তারা এই হিসাব তৈরি করেছে। তবে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে তারা যে তথ্য পেয়েছে, তাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার, অ্যাকশনএইড, অক্সফাম কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, ওয়াটারএইড, সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজসহ (সিএনআরএর) ৩৫টি সংস্থা মিলে এই প্ল্যাটফর্ম গঠিত। সংগঠনগুলো হাওরকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে বলছে, সর্বাধিক জাতীয় গুরুত্ব দিয়ে হাওরের সংকট মোকাবিলায় সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।
এদিকে গতকাল নতুন করে সুনামগঞ্জের শনির হাওরে বাঁধ ভেঙে ২২ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত দাঁড়াবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। তবে সব হারানোর কষ্ট আর ঘরবাড়ি হারানোর দুর্ভোগ অনেক দিন হাওরবাসীকে ভোগাবে, এতে সন্দেহ নেই কারও।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার হাওরবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে হাওরাঞ্চলের কৃষিঋণের সুদ মওকুফ এবং ঋণ আদায় বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হাওরের কৃষকদের পরবর্তী ফসলের মৌসুমে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। হাওরে ধান নষ্ট হওয়ার ফলে দেশের মোট ধানের উৎপাদন কমবে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় অন্য এলাকায় বোরোর উৎপাদন বাড়বে। তা ছাড়া হাওরের সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য ও সর্বাত্মক চেষ্টা সরকারের রয়েছে।
হাওরে দারিদ্র্য বেশি
হাওরের উন্নয়ন ও গবেষণা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, এই ক্ষতির প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। সরকারের হাওর মহাপরিকল্পনার হিসাবে দেশের মোট ধানের ১৮ শতাংশ এবং উন্মুক্ত উৎসের মাছের ২৮ শতাংশ আসে হাওর থেকে। দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) হাওরের অবদান ৬ শতাংশ।
হাওরের জীবন-জীবিকাবিষয়ক অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাওরে দারিদ্র্যের হারও জাতীয় হারের চেয়ে বেশি। ওই সময়ে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৯ হাজার ৬৮৮ টাকা। আর হাওরবাসীর আয় ছিল ৯ হাজার ২৯ টাকা। একই সময়ে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগোষ্ঠী ছিল ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ, হাওরে তা ছিল ২৮ শতাংশ।
ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে পার্থক্য
সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্মের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। গতকাল ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে হাওর পরিস্থিতি নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে কৃষিসচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ জানান, চালের হিসাবে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬ লাখ টন। আর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, মাছের ক্ষতি ১ হাজার ২৭৫ টন এবং হাঁস মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪০টি।
অন্যদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব তৈরি করা হয়েছে, তাতে ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ৬টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫টি ঘরবাড়ি পরিপূর্ণ ও আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্মের সদস্যসচিব আনিসুল ইসলাম বলেন, হাওরে কাজ করার প্রায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতায় এত বড় বিপর্যয় তিনি দেখেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমাহীন গাফিলতির কারণে এই ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, হাওরের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়নি যে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। পরিস্থিতি এখনো তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আছে। পরিস্থিতি মোকাবিলার সামর্থ্য সরকারের রয়েছে।
ত্রাণমন্ত্রী জানান, হাওরের ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে আগামী ১০০ দিন প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। আর ৫০০ টাকা করে নগদ দেওয়া হবে। এ জন্য ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ও ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
হাওর প্লাবিত হওয়ার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি বা দুর্নীতি দায়ী কি না—এমন প্রশ্নে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খান বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি হওয়ায় এই প্লাবন হয়েছে। হাওরের বাঁধ টপকে পানি ঢুকেছে। ফলে এই বাঁধ আরও উঁচু করা যায় কি না, তা ভাবা হচ্ছে।
হাওরে পরমাণু শক্তি কমিশন দল
সিলেট ও সুনামগঞ্জ অফিস থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, হাওরে পানিদূষণ, দুর্গন্ধ, মাছ ও হাঁস মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল সুনামগঞ্জে অবস্থান করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। দূষিত পানি, মাটি, বালু, মরে যাওয়া মাছ, হাঁস ও জলজ উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো ঢাকায় তাদের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা।
গতকাল বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ভৌতবিজ্ঞান বিভাগের সদস্য দিলীপ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পাঠানো নমুনা রোববার সকাল থেকে ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দলের অন্যরা হলেন কমিশনের প্রধান দুই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দেবাশীষ পাল ও বিলকিস আরা বেগম।
হাওরের পানিদূষণের কারণ কাঁচা ধানগাছ পচে যাওয়া নাকি অন্য কিছু? এ বিষয়ে দিলীপ কুমার সাহা বলেন, ইউরেনিয়ামের কারণে হাওরে পানিদূষণ হয়েছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদলও গতকাল বিভিন্ন হাওর ঘুরে পানি পরীক্ষা করেছে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, হাওরে সাত ফুট পানির নিচে আলো প্রবেশ করছে। তার মানে পানি পরিষ্কার। পানিতে অন্য কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য মিশে থাকলে পানি এত পরিষ্কার থাকার কথা নয়। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কিছু নেই। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1155651/