২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৪৫

শিল্পপতি থেকে দোকানি সবার গলায় ফাঁস

কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদনের পর পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা দোকানদার থেকে সর্বশেষ ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি হাতবদলেই মূসক বা ভ্যাট বসবে পণ্যের ওপর। ভোক্তা যখন সর্বশেষ বিক্রেতার কাছ থেকে সেটি কিনবে, তখন সে নতুন আইন অনুযায়ী ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ পণ্যমূল্য পরিশোধ করবে। সর্বশেষ স্তরে পাওয়া এই ভ্যাট কাঁচামালের বিক্রেতা থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে বিক্রি করা দোকানদার—সবাইকে নিজের লভ্যাংশ ও কমিশন হিসাব করে সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। আবার বছরের হিসাব বছরে রাখলে হবে না, আইনের ১০৭ ধারায় বলা আছে, পাঁচ বছর পর্যন্ত সবাইকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের হিসাবাদি, দলিলপত্র ও অন্যান্য রেকর্ডপত্র (ভাউচার) সংরক্ষণ করতে হবে। অক্ষরজ্ঞানহীন ছোট বিক্রেতা থেকে বড় শিল্প মালিক—যে কেউই এই হিসাবে ভুল করলে আইন অনুযায়ী শুধু তিনিই শাস্তি পাবেন না, গ্রেপ্তার করা হবে তাঁদের আত্মীয়স্বজনকেও।

নতুন আইনের ১৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে ভিন্নতর কিছু না থাকিলে, করযোগ্য সরবরাহ বা করযোগ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূসক (ভ্যাট) হার হইবে ১৫ (পনের) শতাংশ। ’ অর্থাৎ কয়েকটি বাদে দেশের সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করবে সরকার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই এমন ঢালাও করহার নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প ও সেবা খাতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে উৎপাদক ও বিক্রেতা সব পর্যায় মিলিয়েও ১৫ শতাংশ মুনাফা হয় না। সে ক্ষেত্রে সরকার ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নিলে অনেক শিল্প ও সেবা খাতে ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বিদ্যমান আইনে অনেক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট নেই, কোনো কোনো পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ৫ ও ১০ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। নতুন আইনে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যমূল্য বাড়বে। শুধু পণ্যের ওপরই যে ভ্যাট বাড়ছে তাই নয়, বিদ্যুৎ বিলের ওপর বিদ্যমান ভ্যাট ৫ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ হবে। পরিবহন ব্যয়ের ওপরও ভ্যাট বাড়বে। এসব স্তরে এভাবে ভ্যাট বাড়ায় পণ্যমূল্য অনেক বাড়বে। তাতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। বাজারে চাহিদা কমলে শিল্পের উৎপাদনও কমবে। তার চূড়ান্ত প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে। অন্যদিকে ৪৪৭টি আমদানি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমদানি
করা পণ্যের দাম কমে যাবে। একদিকে দেশি পণ্যের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে আমদানি পণ্যের মূল্যহ্রাসের কারণে দেশীয় ব্যবসায়ীরা বিদেশি পণ্যের কাছে বাজার হারানোর আশঙ্কা করছেন। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা বলছেন, ‘দেশীয় শিল্প ও সেবা খাতের স্বার্থে সম্পূরক শুল্ক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে দেশি শিল্প সুরক্ষায় বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে। ’
সরকার ভ্যাট থেকে রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন আইনে প্যাকেজ ভ্যাট বাতিল করে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানোর ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এফবিসিসিআই বলছে, আইনটি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাবান্ধব না হওয়ায় এ খাত থেকে বাড়তি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। গত ২০ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া বাজেট প্রস্তাবে সংগঠনটি নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বলেছে, ‘মূসক আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যেন এর দ্বারা ব্যবসার স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়। মূসক আইনের বিধিবিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবসার সাধারণ গতিকে অনুসরণ করা উচিত। আইনের প্রয়োগকে অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে বাধ্য করা হলে এর গতি বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর ফলে মূসক আদায় হ্রাস পায়। মূসক আইনের কিছু সাধারণ আদেশ ও আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে সৃষ্ট জটিলতার জন্য উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এসব আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কোষাগারে কোনো বাড়তি মূসক জমা পড়ছে না, বরঞ্চ উদ্ভূত জটিলতার জন্য ব্যবসা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায় মূসক আদায়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংশ্লিষ্ট আদেশসমূহে সংশোধনীর মাধ্যমে এসব জটিলতার আশু নিরসন জরুরি হয়ে পড়েছে। ’
এফবিসিসিআই বলেছে, বসবাসের ফ্ল্যাট বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যৌথ উদ্যোগে নির্মিত আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়। সে ক্ষেত্রে মোট মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং যে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়, তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হবে।
অর্থাৎ একটি ফ্ল্যাটের মূল্য এক কোটি টাকা হলে সেখানে বাড়তি মূল্য সংযোজন বা মুনাফার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা। অথচ নতুন আইনে এক কোটি টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ১৫ লাখ টাকা ভ্যাট আরোপের কথা বলা আছে। এফবিসিসিআই বলছে, যে ১০ লাখ টাকা মূল্য সংযোজন হয়েছে, তার ১৫ শতাংশ বা দেড় লাখ টাকা ভ্যাট আরোপ করতে হবে। একইভাবে লৌহ বা ইস্পাত শিল্পে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন ধরে তার ১৫ শতাংশ বা মোট সরবরাহ মূল্যের দশমিক ৭৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করতে হবে।
হাসপাতাল, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন সেবা খাতে মূল্যভিত্তিক ও রেয়াতবিহীন ১৫ শতাংশ ভ্যাট অযৌক্তিক উল্লেখ করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব সেবা খাতে ২৬.৬৭ শতাংশ মূল্য সংযোজন হিসাব করে তার ওপর ১৫ শতাংশ বা বিক্রয়মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করতে হবে। একইভাবে ইটের বিক্রয়মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর বদলে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হিসাব করে তার ওপর ১৫ শতাংশ বা মোট বিক্রয়মূল্যের ওপর দেড় শতাংশ ভ্যাট নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন তাঁরা।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামে শুধু রপ্তানি পণ্যই নয়, ওই পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করতে আনুষঙ্গিক আরো যেসব পণ্য ও সেবা দরকার হয়, তার সবই মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাটমুক্ত। বাংলাদেশে নতুন আইনে রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে ব্যবহূত স্থানীয় বা আমদানি করা অন্য সব পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ একটি শার্ট যে প্যাকেট বা কার্টনে ভরে রপ্তানি করা হবে, সেই প্যাকেট বা কার্টন কিনতে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট দিতে হবে। একইভাবে বাংলাদেশে কৃষি খাতে ব্যবহূত সব উপকরণের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হচ্ছে, ভিয়েতনামে সেগুলোতে কোনো ভ্যাট দিতে হয় না।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন আইনে যেভাবে সব পণ্যের ওপর একদিকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ এবং আমদানি পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাতে বড় ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে, দুর্বল অবকাঠামো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করে বিদেশি সস্তা পণ্যের সঙ্গে এমনিতেই পেরে ওঠেন না। এ অবস্থায় দেশি পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে বিদেশি পণ্যকে ছাড় দেওয়া হলে দেশের শিল্প ও সেবা খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আমরা তা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছি। আগামী ৩০ এপ্রিল ও ২ মে বাজেট নিয়ে আলোচনাকালে আমরা অর্থমন্ত্রীকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণের জন্য চাপ দেব। তাতেও কাজ না হলে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হব। ’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাট বাড়ালে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। তাতে মূল্যস্ফীতিও মাত্রা ছাড়াবে। সে হিসাবে ভ্যাটের হার কোনোমতেই ৭ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। ’
এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন ভ্যাট আইনে অনেক ভালো দিক আছে। তবে কয়েকটি ধারা এতই খারাপ যে ব্যবসায়ীরা আইনটি মেনে নিতে পারছেন না। সব পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অনেক বেশি। এটি বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে কোনোমতেই কাম্য নয়। বাংলাদেশের শিল্প ও সেবা খাত এত ভ্যাটের ভার বহনের সক্ষমতা এখনো অর্জন করেনি। আমরা তাই বিভিন্ন পণ্য ও সেবাভেদে বিভিন্ন হারে ভ্যাট আরোপের দাবি তুলেছি। ’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে আইনটি করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এটি সংসদে পাস হয়েছে ২০১২ সালে। আইনটি যদি ভালোই হতো, তাহলে এত দিনে অবশ্যই বাস্তবায়ন হতো। আমরা আইনের কয়েকটি বিতর্কিত ও ধ্বংসাত্মক ধারা সংশোধন করতে সরকারের সঙ্গে ২০১২ সাল থেকেই ধারাবাহিক সভা করে যাচ্ছি। অর্থমন্ত্রীর গঠিত এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের যৌথ কমিটি বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের জন্য একমত হলেও হঠাৎ করেই সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে। এটি কোনোমতেই কাম্য নয়। এনবিআর মুখে বলে যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে ভ্যাট আইন কার্যকর করবে, কিন্তু তাদের মধ্যে সে ধরনের কোনো তাগিদ দেখি না। ’
বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতি আরো বলেন, ‘নতুন আইন কার্যকর হলে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের ওপরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে। দেশের অনেক গরিব মানুষ যেখানে টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারে না, সেখানে তাদের কাছে ভ্যাট চাওয়া চরম অমানবিক। ’
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের কোনো প্রস্তাব না মেনে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করলে সাধারণ ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও সরকার সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, এই আইন সাধারণ ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, করপোরেট ব্যবসায়ীদের জন্য। অন্যদিকে দেশের ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী সাধারণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির। নতুন ভ্যাট আইন অনুসারে সব স্তরে হিসাব রাখতে হবে। এই ব্যবসায়ীরা উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা—এ তিন পর্যায়ে হিসাব রাখতে পারবেন না। এটা যেমন সহজ কাজ নয়, তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বড় অংশেরই হিসাব রাখার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা এখনো প্রয়োজনীয় চালান দিতে পারেন না। তাঁরাও ভ্যাট থেকে রেয়াত পাবেন না। এ অবস্থায় সরকার নতুন ভ্যাট আইন কোনো রকম সংশোধন ছাড়াই বাস্তবায়ন করলে দেশের দুই কোটি ৭০ লাখ ব্যবসায়ীর মধ্যে দুই কোটি ২০ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এফবিসিসিআইয়ের এই পরিচালক বলেন, ‘নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে কোন পণ্যের দাম কতটা বাড়বে, সে হিসাব এফবিসিসিআই বা বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির কাছে নেই। তবে পণ্যভেদে দাম কত বাড়বে, তার একটি তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করছি আমরা। ওই তালিকা তৈরি হয়ে গেলেই সেটি নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব। দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে প্রয়োজনে ব্যবসায়ীরা রাজপথে নামবে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/24/490063