২৪ দিন লড়াই করেও বাঁধ রক্ষা করতে পারেনি কৃষকরা। গতকাল শনির হাওরের বাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে। ছবি : কালের কণ্ঠ
২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৪৩

হাওর ডুবে একাকার

৭ জেলায় ১০ হাজার কোটি টাকার ফসলহানি

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আশপাশের সব হাওর তলিয়ে গেলেও এত দিন টিকে ছিল শনির হাওর। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত এ হাওরের বাঁধগুলো রক্ষায় স্থানীয়রা ২৪ দিন ধরে দিনে-রাতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত পানির তোড়ের কাছে হার মেনেছে বাঁধ। শনিবার গভীর রাতে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। গতকাল রবিবার সকালে নান্টুখালী-ঝালোখালী বাঁধ ভেঙে যায়। সকালেও শতাধিক কৃষক বাঁধ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও পানি আটকানো যায়নি। ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ জমির আধাপাকা বোরো ধান।

শনিবার তাও আধাপাকা অবস্থাতেই কিছু ধান কেটেছিল কৃষকরা। গতকালও সকাল সকাল অনেকে অল্প কিছু ধান কাটতে পেরেছে। তবে বেশির ভাগ কৃষকই ধান কাটতে পারেনি। কারণ হিসেবে তারা বলছে, আধাপাকা এ ধান কেটেই বা কী হবে! বাঁধ ভাঙার খবরে কৃষকরা জড়ো হয়েছিল হাওরের বিভিন্ন স্থানে। তাদের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে ডুবে যায় ফসলের ক্ষেত। আর কয়েক দিন পরই হাওরে ফসল কাটার উৎসব শুরু হতো। সেখানে এখন কেবলই হাহাকার।
ফসল তলিয়ে যাওয়ায় হাওরাঞ্চলের কৃষকরা চরম বিপাকে পড়েছে। অনেকে ধারদেনা করে ধান লাগিয়েছিল। এমনকি অনেক কৃষক গত বোরো মৌসুমের ধারের টাকাই এখনো শোধ করতে পারেনি। এবার ধান কাটার পর একসঙ্গে দুই মৌসুমের ধার শোধ করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ এভাবে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় তারা অসহায় হয়ে পড়েছে। অনেক কৃষকের ঘরে পর্যাপ্ত খাবারও নেই।
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গত মাসের শেষের দিক থেকে সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ধান তলিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, হাওরের বাঁধগুলো মেরামত ও নতুন করে নির্মাণে দুর্নীতির কারণেই এভাবে ফসলহানি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই সাত জেলায় এ বছর ৯ লাখ ৩০ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল।
এসব জেলার ২৩ লাখ ৭১ হাজার ১৬টি কৃষক পরিবার বোরো চাষের ওপরই নির্ভরশীল। কৃষি বিভাগের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬১ টন চাল। বর্তমান বাজারদরে টনপ্রতি ৪৫ হাজার টাকা হিসাবে হাওরাঞ্চলে এবার মোট ১৩ হাজার ৩০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদিত হওয়ার কথা।
বৃষ্টিতে হাওরাঞ্চলের আশপাশের নদ-নদীগুলোর পানিও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই নদীর পুরনো তিনটি ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে ইতিমধ্যে ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি বিপত্সীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
২৪ দিনের লড়াই শেষে হেরে গেল শনির হাওরের কৃষক : গত ২৯ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণ শুরু হয়। এতে একে একে তলিয়ে যায় জেলার ১৩২টি হাওর। ৩১ মার্চ থেকে হাজারো কৃষক শনির হাওরের চারটি পয়েন্টের বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছে। ঝুঁকি থাকলেও কৃষকদের চেষ্টায় এত দিন হাওরে পানি ঢোকা ঠেকানো গিয়েছিল। কিন্তু গত তিন দিনের অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের চাপ সইতে পারেনি বাঁধগুলো।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাব অনুযায়ী, শনির হাওরে এবার আট হাজার ২৯৮ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ধান উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এখন বিস্তীর্ণ জমির ধান তলিয়ে গেছে।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে আকাশ যখন মেঘের দখলে তখন তাহিরপুরে সাহেবনগরের পাশের জঙ্গ দাশের ভিটা ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে শোঁ শোঁ শব্দে পানি ঢুকছিল হাওরে। বাঁধের উত্তর পাশে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব কৃষক মো. বুরহান উদ্দিন। সাহেবনগর গ্রামেই তাঁর বাড়ি। বাঁধ যেখানে ভেঙেছে তার প্রায় গোড়াতেই ছিল তাঁর ফসলের ক্ষেত। সকালে সবার আগে তিনি বাঁধে এসে দেখেন বুরুঙ্গা (ছিদ্র) দিয়ে পানি ঢুকছে। নিজের ফসলের মায়ায় ইটভর্তি কয়েকটি বস্তাও ফেলেন তিনি। তবে পানির তোড় সেগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রায় আধঘণ্টা ধরে চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেননি তিনি। তাঁর চোখের সামনেই দুই হাত পরিমাণ ভাঙা জায়গা কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ২০ হাতের সমান হয়ে যায়।
বিকেল ৪টা পর্যন্ত বুরহান উদ্দিন চেয়ে চেয়ে দেখেছেন ফসলের ডুবে যাওয়ার করুণ দৃশ্য। গতবার শনির হাওর ডুবেছিল সবার আগে, এবার ডুবল সবার শেষে। এ হাওরের বাঁধের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৫২ কিলোমিটার। গতকাল সকালে লালুর গোয়ালা বাঁধ ও জঙ্গ দাশের ভিটা ভেঙে হাওরে পানি ঢুকতে থাকে। সারা দিনে দুই-তৃতীয়াংশ বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়।
বুরহান উদ্দিন বলেন, ‘সকাল ৭টায় আইয়া দেখি দুই আত ভাঙা। ইটা মারি বস্তা ফালাই আউরে। বস্তা লইয়া যাত ফোত। বারবার দেই, বারবার নেয়। বাইন্দা রাখতাম পারছি না। ’ জানা গেল, ভাঙা বাঁধের নিচেই ছিল তাঁর সাড়ে তিন একর জমি। ধানে হলুদ রংও ধরতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখন সব শেষ। গতবার আর এবার মিলিয়ে তাঁর দেনা দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। কী খাবেন আর কিভাবে দেনা শোধ করবেন তা ভেবে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
তাঁর পাশেই আহাজারি করছিলেন একই গ্রামের কৃষক শিহাব কামাল। তিনিও এই হাওরে তিন একর জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। তাঁর চোখের সামনে ধীরে ধীরে তলিয়ে গেছে পুরো জমি।
এমন সময় বাঁধ এলাকায় ছোটাছুটি করতে দেখা গেল তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুলকে। গত ৩১ মার্চ থেকে টানা রাত-দিন বাঁধে অবস্থান করে কাজ করেছেন তিনিও। ফসল ডুবিতে বিপর্যস্ত কৃষকদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তিনি।
শনির হাওরে বাঁধে টানা ২৪ দিনই ছিলেন মনেছা বেগম। হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় গত ২৯ মার্চ রাতে। উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামানসহ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নেতৃত্বে দুই উপজেলার ৪০ গ্রামের অন্তত দেড় হাজার মানুষ প্রতিদিন স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষার কাজ করছিলেন। একমাত্র নারী হিসেবে সেই কাজে যোগ দিয়েছিলেন জামালগঞ্জের বেহেলি ইউপির সদস্য মনেছা বেগমও। শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত টিকে ছিল শনির হাওরের ১১টি স্থানের বাঁধ। এর মধ্যে লালুগোয়ালা নামের বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ তদারক করছিলেন তিনি। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বিষণ্ন মনে গতকাল ভোরে বাড়ি ফিরে যান তিনি।
গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে মনেছা বেগম বলেন, ‘কী আর কইয়াম। রাইত ১২টায় কপাল পুড়ল। লালুগোয়ালার উত্তরে দিয়া বড় আফর (বাঁধের ভাঙা অংশ) দিয়া করি পানি ঢোকে। আমি ট্রলার নিয়া বাঁধে আই। মানুষরে ডাকাডাকি করি। বুকসমান পানিত নাইমা বালুর বস্তা ফালাইছি। ফজরের আজানের সময়ই সব শেষ। খুব খারাপ লাগছে। বাড়িত আইয়া উঠানে বইয়া আছি!’
জঙ্গ দাশের ভিটা ফসলরক্ষা বাঁধের ঠিক আধা কিলোমিটার দূরেই লালুর গোয়ালা বাঁধ। এ বাঁধটিও একই সময়ে ভেঙে প্রবল বেড়ে হাওরে পানি ঢুকেছে। বাঁধের নিচের অংশে দেখা গেল কৃষকরা জাল নিয়ে মাছ ধরতে নেমেছেন। হাওরটি এত দিন টিকে ছিল বলে পানি এখনো দূষিত হয়নি।
গতকাল দুপুর ১টায় শনির হাওরপাড়ের গ্রাম মধ্য তাহিরপুরের দক্ষিণে কথা হয় কৃষক বিনয় রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই একর জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। সকাল (রবিবার) থেকেই ধান ডুবতে শুরু করে। দুপুরের মধ্যেই অর্ধেক জমি তলিয়ে যায়। আধাপাকা ধান কাটার ইচ্ছে থাকলেও শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারিনি।
তাঁর পেছনেই শতচ্ছিন্ন জামা গায়ে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রমিক অনিল দাস। পরের জমিতে ধান কেটে ভাগে যা পান তা দিয়েই তাঁর সংসার চলে। অনিল দাস বলেন, ‘পরের জমিত খাইট্টা খাই। ইবার তো খাওয়ার উপায় নাই। সব শ্যাষ অইয়া গেছে। কিলা বাঁচতাম ভাই। ’
হাতে কাঁচি নিয়ে আগেভাগে কাঁচা ধান কাটতে বিন্নাকুলি গ্রাম থেকে এসেছিলেন শ্রমিক রুবেল ও একাদুল মিয়া। তাঁরা জানালেন, ছয় মুঠি ধান কাটলে একমুঠ ভাগে পান তাঁরা। গত শনিবার থেকে এভাবেই কৃষকের আধাপাকা ধান কাটছেন। তবে পানি ঢুকে পড়ার আগে আগে আজ (রবিবার) অল্প কিছুটা কাটতে পারলেও কাল থেকে (সোমবার) আর পারবেন না।
উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘দেইখ্যো কালকে থাকি আকাশ ভালা অইজিব। শনির হাওর খাইলিছেতো। এখন আর মেঘ-তুফানও আইতো না। আমরারে মাইরা নিজে ডুবে মরছে এখন। ’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, শনির হাওরের নিচের অংশ আরো আগেই আক্রান্ত হয়েছিল। এবার সব মিলিয়ে ৮০-৯০ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে।
উৎসবের বদলে হাওরজুড়ে হাহাকার : কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের কলাপাড়ার প্রান্তিক চাষি রুশন আলী ফকির গতকাল সকালে দুমুঠো চিড়া ভিজিয়ে খেয়েছিলেন। দুপুরে কিছু খাননি, ঘরে খাবারও নেই। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান দোকান থেকে চাল আনতে গিয়েছিলেন। দোকানি মোটা চালের কেজি ৪৮ টাকা হাঁকায় আর ওপথ মাড়াননি। চালের বদলে চার কেজি আটা কিনে এনেছেন। কিন্তু ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মেয়ে অরুণার বায়না, সে রুটি খাবে না। তাকে ভাত দিতে হবে।
গতকাল বিকেলে কথা হয় নূরজাহানের সঙ্গে। তাঁর স্বামী রুশন আলী ফসলহানির শোকে ঘরে কাঁথামুড়ে শুয়ে ছিলেন। নূরজাহান জানান, ঋণ করে ও সুদে টাকা এনে হাওরে তিন একর জমি এক বছরের জন্য পত্তন নিয়ে তাঁর স্বামী বোরো চাষ করেছিলেন। গত কয়েক দিনের ঢলের পানি ও ঝড়-বাদলের তোড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। রুশন আলী সকালে হাওরে গিয়ে গরুর জন্য কাঁচা ধানই কেটে নিয়ে এসেছেন। এখন সারা বছরের খোরাকি ও চার মেয়ের লেখাপড়া করাবেন কী করে এ দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
একই গ্রামের প্রয়াত আলফু মিয়ার স্ত্রী আবেদা খাতুনসহ অন্য কিষানিরা জানান, বৃষ্টি ও ঢলের পানি বাড়ায় সব ডুবে গেছে। কী খাবেন, কী করবেন—সবার ভাবনা এখন একটাই। তাঁদের ভাষ্য, ‘অহন আর কিছু বাদ নাই। সোনার হাওর অহন পুরা ধইল্যা সাদা। ’
উপজেলার কলমা ইউনিয়নে মোট খানার (পরিবার) সংখ্যা তিন হাজার ২৫০। লোকসংখ্যা অন্তত ১৫ হাজার। এ ইউনিয়নের কোনো কৃষক ঘরে একমুঠ ধানও তুলতে পারেনি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাধাকৃষ্ণ দাস জানান, আশপাশের পুরো হাওর পানিতে ডুবে আছে। অথচ এখন ফসল তোলার কথা ছিল। তার বদলে চারদিকে পানি আর পানি।
রাধাকৃষ্ণ দাস জানান, তাঁর এলাকার ৫০ শতাংশ কৃষকের ঘরেই চাল নেই। গতবারের খোরাকিও শেষ হয়ে গেছে। গ্রামের হাট-বাজারে টাকা দিয়েও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। ত্রাণ অধিদপ্তর থেকে সরবরাহ করা দুই টন চাল এর আগে বিতরণ করা হয়েছে। সোমবার (আজ) আরো পাঁচ টন দেওয়া হবে। এত মানুষের মধ্যে এত কম চাল বণ্টন করা কঠিন।
কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গত বোরো মৌসুমে ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৮৯৮ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত হয়েছিল। কৃষক, জনপ্রতিনিধি ও হাওরবাসীর হিসাব মতে, গতকাল পর্যন্ত হাওরাঞ্চলে ৮০ ভাগ ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা পাহাড়ি ঢল, প্রবল বর্ষণ, শিলা ও ঝড়ে হাওরাঞ্চলে ১০ হাজার কোটি টাকার ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
তাড়াইলের দামিহা ও দিগদাইড় ইউনিয়নের কৃষকদের সব জমি কাওড়ারবন্দ এলাকায়। নরসুন্দা নদী ও সংযোগ খালটির মধ্যবর্তী প্রায় আধাকিলোমিটার দীর্ঘ ফসল রক্ষা বাঁধটি এলাকার কৃষকরা এত দিন প্রাণপণে রক্ষা করেছিল। শনিবার বাঁধটি ধসে প্রায় এক হাজার ২০০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে।
একইভাবে ইটনা, মিঠামইন, করিমগঞ্জ, বাজিতপুর ও অষ্টগ্রামের উঁচু এলাকার কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল নতুন করে জলমগ্ন হয়েছে। কৃষকরা বলছে, এত দিন এসব জমির ফসল ঘরে তোলার আশা জেগেছিল। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সে আশাও শেষ।
হাওরের কৃষকরা জানায়, বিস্তীর্ণ হাওরে এ সময়ে ধান কাটার উৎসব শুরু হতো। নতুন ফসল ঘরে তুলে মহাজনি ঋণ, সুদের টাকা শোধের পর সারা বছরের খোরাকির ধান গোলায় রাখত কৃষক। এবার বিপর্যয়ে সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
মিঠামইনের ঘাগড়ার খাড়াহাটির তোফাজ্জল মিয়া বলেন, গ্রামের পাশের অল্প পরিমাণ জমির ফসল কাটতে পেরেছিল ওই এলাকার কৃষকরা। টানা বৃষ্টিতে ধান মাড়াইয়ের খলা ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাওয়ায় ওই ধানও পচে যাচ্ছে। একই অবস্থা হাওরের সব এলাকায়।
অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মর্জিনা বেগম নিজেই তলিয়ে যাওয়া ফসল কাটতে কাস্তে নিয়ে গ্রামের পাশের হাওরে নেমেছিলেন। পায়ে আঘাত পেয়ে ফিরে গেছেন। গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি জানান, তিন একর জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। একমুঠ ধানও ঘরে তুলতে পারেননি।
কৃষি বিভাগ জানায়, গতকাল পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের এক লাখ ৪২ হাজার ৫৬৮ হেক্টর জমির বোরো ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে মার গেছে প্রায় পাঁচ লাখ ৩২ হাজার টন চাল। টাকার অঙ্কে কেবল কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরের কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে ৯০৫ কোটিরও বেশি। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এর দেড় গুণের বেশি হতে পারে।
হাওরের এ বিপর্যয়কে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে ‘হাওরের মহাবিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ’ নামে হাওর অঞ্চলবাসীর একটি ফোরাম। ফোরামের আহ্বায়ক আকরামুল হক স্বাক্ষরিত বিবৃতিকে বলা হয়, ফসলহানির শিকার কৃষকদের বাঁচাতে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারিসহ কৃষকদের সব ধরনের ঋণ মওকুফ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আগাম উদ্যোগ নিতে হবে।
জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে জানান, গত দুই দিনে জেলার হাওরাঞ্চলে নতুন করে আরো ১০ হাজার একর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ হিসাবে চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করা হচ্ছে। গতকাল তিনি ও জেলা প্রশাসক মো. আজিমউদ্দিন বিশ্বাসসহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা মিঠামইনের গোপদীঘিসহ বিভিন্ন গ্রামে ত্রাণের চাল বিতরণ করেছেন।
ধলই নদীর পানি বেড়ে ২৫ গ্রাম প্লাবিত : মৌলভীবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কমলগঞ্জের মুন্সীবাজার ইউনিয়নের কয়েকটি বিদ্যালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, করিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর জালালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রুপসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক জানান, বিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। এ অবস্থায় প্রথম সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পানি না কমলে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না।
মুন্সীবাজার ইউপির সদস্য নুরুজ্জামান জানান, গত শনিবার রাতে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ধলই নদীর বাদে করিমপুর, গোপালনগর, কোনাগাঁও—এ তিন স্থান দিয়ে পানি ঢুকতে থাকে। গতকাল ভোর থেকে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে করিমপুরের ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ ঠেকাতে চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি খুব একটা। পাউবোর গাফিলতির কারণে তিন দফা একই স্থান দিয়ে পানি ঢুকেছে। পাউবো যথাসময়ে বাঁধের ভাঙন বন্ধ করলে আজ এ অবস্থা হতো না।
পানি ঢুকে পড়ায় বোরো ধান ও আউশের বীজতলা তলিয়ে গেছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, ধলই নদীতে এর আগে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের প্রস্তুতির সময়ই গতকাল আবার পানি ঢুকেছে। স্থায়ীভাবে বাঁধ মেরামতের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি পাস হলে ব্লকের মাধ্যমে কাজ করা হবে।
অসময়ের বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওরসহ মৌলভীবাজারের সাত উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও জেলেদের সরকারিভাবে সহযোগিতা এবং মৌলভীবাজারকে দুর্গত জেলা ঘোষণার দাবিতে গতকাল সকালে জেলা সদরের চৌমোহনায় হাওর বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে ১১ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
খোয়াই নদীর পানি বিপত্সীমার ওপরে : হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পাউবো সূত্র জানায়, শনিবার রাত ১টা পর্যন্তও খোয়াই নদীর পানি বিপত্সীমার ৯.৫ মিটারের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এরপর হঠাৎ পানি বাড়তে থাকে। গতকাল সকাল ১০টায় পানি বিপত্সীমার ৭০ সেন্টিমিটার এবং দুপুর ১টায় বিপত্সীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এতে প্রতিরক্ষা বাঁধগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আজমিরীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতেও পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম জানান, নিম্নচাপের কারণে বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশে বৃষ্টিপাতের কারণে খোয়াই নদীর পানি বেড়েছে। পাউবোর পক্ষ থেকে খোয়াই তীরবর্তী বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/24/490062