২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৯:২৫

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে

রাজধানীতে একটি গোলটেবিল আলোচনায় রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে, সুন্দরবনকে ধ্বংস করে দিবে, যা দেশের মানুষ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক আত্মঘাতি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল আইন লঙ্ঘন করেই রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্প পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। না হলে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র-সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন সেভ দ্য সন্দুরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, সাবেক মহাপরিচালক পাওয়ার সেল, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী বি ডি রহমতুল্লাহ, গণমোর্চার প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ড. মো: মোজাহেদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার সভাপতি ডা. একিউএম বদরোদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন তারা দেশবিরোধী বা বিদ্যুৎ বিরোধী নয়। তারা সরকারের শত্রুও নয়। এই প্রকল্প সুন্দরবনকে ধ্বংস করে দিবে। দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে জানিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে শেষ বারের মতো সঠিক তথ্য জেনে বিষয়টি পুর্নবিবেচনার আহ্বান জানান। অন্যথায় রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, অতীতে যারা গণবিরোধী কাজ করেছে তারা বুঝতে পারেনি। ব্রিটিশরা, পাকিস্তানিরা বুঝতে পারেনি। জনগণ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। এরশাদ বুঝতে পারেনি। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল জনগণ। সরকারকে মানুষের সমস্যা বুঝতে হবে। নয়তো জনগণ বুঝিয়ে দিবে। অন্যথায় রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই।
বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ বলেন, সুনামগঞ্জে হাওরের পানি ইউরেনিয়ামের কারণে দুষিত কি-না তা পরীক্ষা করে ২৪ ঘন্টার মধ্যে জাতিকে জানাতে হবে। আমাদের দেশে অনেক বিজ্ঞানী আছেন, তারা সহজেই এই সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতির বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন। সুনামগঞ্জের পানি ইউরেনিয়ামে ভরে গেছে কি-না তা খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগবে না। তিনি বলেন, পানি যে বিষাক্ত তার প্রমাণ হাঁস মরে যাচ্ছে, কিন্তু মুরগি মরছে না। পানিতে চলাফেরা করা এবং মাছ খাওয়ার কারণেই হাঁস মারা পড়ছে। এই বিষ কি ধান না কাটার বিষ না পচা ধানের বিষ? এমন প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন তা সমাধান করতেই হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, শেষবারের মতো বলব, রামপালের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথাগুলো শুনুন। সরকার বোঝে না, তাদের বোঝাতে হবে। সোজা কথা, বাংলাদেশে কয়লাবিদ্যুৎ হবে না। সরকারকে বোঝাতে হবে সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কি ক্ষতি করবে। তাতেও কাজ না হলে জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে আন্দোলন ছাড়া কোনো দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, এতো বড় একটা ইস্যু নিয়ে এত ছল ছাতুরি কেন? কোন প্রকল্প করার আগে পরীক্ষা হয় জরিপ হয়। এরপর পরিবেশ ছাড়পত্র। তারপর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু তা না করে নানা ছল-চাতুরি। এতো ছল-চাতুরি কেন? জনমতের তোয়াক্কা না করেই তা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদে যে প্রক্রিয়ায় আন্দোলন করা দরকার তাই করা হবে। গণবিরোধী এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পরীক্ষা নিরিক্ষা করে এসব প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পরিবেশর ক্ষতি হয় কী না। কিন্তু এ প্রকল্পের জন্য পরীক্ষা নিরিক্ষার আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৩২০ একর জমির উপর পরীক্ষা নিরিক্ষা কারা হয়েছে। কিন্তু অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২৬৪০ একর। ভারত এ প্রকল্পে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে। অথচ ভারতের মাটিতে এ প্রকল্পের জন্য অনুমোদন দেয়নি। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, রামপালের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তারা রাজাকার আবার সরকারের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন রামপাল প্রকল্পের দূষিত বাতাস সুন্দরবনের দিকে যাবে না। তাহলে কী আমাদের সরকার বাহাদুর বাতাসকেও নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে। আল্ট্রাসুপার কিংবা সুপার টেকনোলজি ব্যবহার করে যদি পরিবেশ রক্ষা করা যেত তাহলে ভারতে কেন এই প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে এমন প্রশ্ন রাখেন নজরুল ইসলাম খান।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ধ্বংসাত্মক রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুনর্বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করে বলেন, এই প্রকল্প নির্মাণ দেশ, দেশের মানুষ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক আত্মঘাতি। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে কী ক্ষতি হবে তা স্পষ্ট। তবুও সরকারের সমস্যা কি? সরকার কি বধির? না বধির নয়। জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে। সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে জাগাতে হবে।
এক্ষেত্রে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপিকে এগিয়ে আসতে হবে। বড় দলের অহমিকা ছেড়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামতে হবে। বিএনপি যদি দেশের মানুষের আকাঙ্খা পূরণের ইচ্ছা থাকে তাহলে বিএনপিকে বড় দলর অহমিকা কাটিয়ে রাস্তায় নামতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমতি ও কৌশলী রাজনীতিবিদ মন্তব্য করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবকিছু বেশ সুন্দরভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রায় সবক্ষেত্রে তিনি সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভারতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ভারতে যাওয়ার সময় তিনি অনেক উপঢৌকন নিয়ে যান। অনেক আশা-আকাঙ্খা ছিল তার। কিন্তু ভারতে তার সমস্ত আশা-আকাঙ্খা শেষ হয়ে গেছে। তাই দেশে ফিরেই তিনি হেফাজতের মন জয় করে নিলেন। তাই আশা করবো একই বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি ধ্বংসাত্মক রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পুনর্বিবেচনা করবেন। তিনি এই প্রকল্পেরর বিরুদ্ধে জনগণকে সাথে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আন্দোলনে নামতে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানান।
মাহমুদুর রহমান মান্না সুন্দরবন রক্ষায় এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনগণকে আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

 

http://www.dailysangram.com/post/280918-