২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৯:২৩

আইএমইডির সরেজমিন প্রতিবেদন

টুইন টাওয়ার বাদ দিয়ে হচ্ছে সাধারণ ভবন

সরকারি আবাসিক ভবন নির্মাণে একনেক সিদ্ধান্তের ব্যত্যয়

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) রাজধানীর মিরপুরে ২০ তলাবিশিষ্ট তিনটি পৃথক টুইন টাওয়ার নির্মাণের অনুমোদন দেয়। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪৫৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক সমস্যা নিরসনে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হলেও টুইন টাওয়ার নির্মাণ হচ্ছে না। একনেক সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাস্তবায়ন পর্যায়ে সব ভবন আলাদা আলাভাবে তৈরি করা হচ্ছে। এ জন্য প্রকল্পের নকশা সংশোধনও করা হয়নি। অনুমোদিত প্রকল্পের এভাবে লে আউট প্ল্যান পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয় বলে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া খরচ বাঁচানোর জন্য প্রি-কাস্ট পাইলিং করায় ব্যাপক শব্দদূষণ এবং ভূ-কম্পনের ফলে আশপাশের ভবনগুলোতে ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই মিরপুরের সুদৃশ্য কুয়েতি মসজিদের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ফাটল। ফলে আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। গত ১৬ এপ্রিল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ চিত্র।


শনিবার সরেজমিন রাজধানীর মিরপুর পাইকপাড়ায় অবস্থিত প্রকল্পটির সাইট ঘুরে প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়া যায়। অন্যদিকে আইএমইডির এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ রোববার প্রকল্পটি পরিদর্শন করবেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে গঠন করা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও। এমনই তথ্য পাওয়া গেছে সরেজমিন পরিদর্শনের সময়।

জানতে চাইলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম শরিবার যুগান্তরকে বলেন, প্রি-কাস্ট পাইলিং হলে ভাইব্রেশন হয় এটা সত্য। আশপাশে যদি বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হয়ে থাকে তাহলে কোনো ক্ষতি হবে না। মসজিদের ক্ষতি হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। কাজের গুণগতমান ঠিক রাখতেই আমরা এই পাইল ব্যবহার করছি। ডিপিপি না মেনে ভবন নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, টুইন টাওয়ার করা হয়নি ব্যবহারকারীদের সুবিধার জন্যই। এটি ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিটেকচারের চিফ আর্কিটেক্টের বিষয়। তিনিই সরকারি সব ভবনের নকশা অনুমোদন করে থাকেন।

সূত্র জানায়, সরকারি কর্মচারীদের আবাসনের সংস্থান, অব্যবহৃত সরকারি জমি অবৈধ দখলমুক্ত করা এবং সেই জমি ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়াতে ‘ঢাকার মিরপুর পাইকপাড়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৬০৮টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে গণপূর্ত অধিদফতর।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নতুন ঝুঁকি হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রি-কাস্ট পাইল দিয়ে ড্রাইভ করায় অটোমেটিক ডিজেল ইঞ্জিনের মাধ্যমে পাঁচ টনের ওয়েট দিয়ে পাইল ড্রাইভ করায় বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক হারে ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। প্রকল্পের এক পাশে প্রধান সড়ক এবং বাকি তিন দিকেই আবাসিক ভবন ও মসজিদ রয়েছে। পাইলিংয়ের কারণে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত হ্যামারিং চলমান থাকায় এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইতিমধ্যেই পাইকপাড়া স্টাফ কোয়ার্টার জামে মসজিদের (কুয়েতি মসজিদ) চতুর্থতলা ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বিভিন্ন অংশে ভার্টিকাল ও হরিজেনটাল ফাটল দেখা গেছে। তা ছাড়া প্রকল্প সাইটের পশ্চিম পাশে বাউন্ডারি সংলগ্ন বেশ পুরনো ব্রিকস ফাউন্ডেশনের কিছু বাড়ি রয়েছে। এসব বাড়িসহ আশপাশে অবস্থিত ভবনগুলোর ফাউন্ডেশন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

প্রতিবেশী আমিনুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভূ-কম্পনের তীব্রতা এতটাই প্রকট যে, টেবিলের ওপর থেকে পানিভর্তি গ্লাস-বোতল পড়ে যায়। এ ধরনের পাইলিংয়ের কারণে আশপাশের ভবনগুলোতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন তিনি। এ ছাড়া শিক্ষা বোর্ড স্টাফ কোয়ার্টারের বি-২ ও বি-১ ভবনের বাসিন্দারা অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেছেন, তারা ভিশন আতঙ্কিত, শিশুরা ভীতসন্ত্রস্ত থাকছে। কোয়ার্টারে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রকল্পের নিকটবর্তী বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ খলিল উল্লাহ এ ধরনের পাইলিং বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। এলাকাবাসীর জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকল্পের প্রি-কাস্ট পাইলিং কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে আইএমইডি। শুধু তাই নয়, ২৪ এপ্রিলের মধ্যে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

প্রকল্প পরিচালক গণপূর্ত অধিদফতরের সাভার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, যতটুকু জানি তা হচ্ছে, ডিপিপিতে খসড়া ডিজাইন দেয়া হয়েছিল। পরে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে টুইন টাওয়ার করা হয়নি। এটা আমাদের বিষয় নয়। ডিপিপির বাইরে কাজ করাটা অনিয়ম নয় বলেও মনে করেন তিনি। তিনি দাবি করেন, ডিজাইনে প্রি-কাস্ট পাইলিংয়ের কথা উল্লেখ রয়েছে।

শনিবার প্রকল্প সাইটে গিয়ে কুয়েতি মসজিদের বিভন্ন স্থানে ফাটল দেখা গেছে। দায়িত্বশীলরাসহ একাধিক মুসল্লি জানান, এ মসজিদে আগে কোনো ফাটল ছিল না। পাইলিং শুরুর পর অতিমাত্রায় ভূ-কম্পনের কারণে এমনটা হয়েছে। প্রকল্পের প্রতিবেশী বাসিন্দা ফ্ল্যাটের মালিক নিজামউদ্দিন জানান, আমাদের এই অংশে শিগগিরই পাইলিং শুরু হবে। ফলে আমরা আতঙ্কিত। প্রকল্পের দেয়ালের খুব কাছে হওয়ায় এসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। এ সময় কথা হয় মিরপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হেলাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা নকশার আলোকেই কাজ করছি।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/23/119448/