২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৯:১৪

হাকালুকি হাওর জুড়ে আহাজারি

সুনশান নীরবতা হাওর পাড়ে। ফসল হারানোর বেদনায় শোকাতুর চাষি পরিবার। অপরিচিত কাউকে দেখলে সরকারি কর্মকর্তা ভেবে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছেন। প্রত্যাশা এই দুঃসময়ে একটু হলেও সরকারি সহায়তা পাওয়ার। ধান আর মাছ হারিয়ে এখন হাওর জুড়ে শোকের মাতম। সর্বগ্রাস করে এখন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে হাওর। কিন্তু কান্না থামছে না কৃষক ও জেলে পরিবারের। সব হারিয়ে দু’চোখের অশ্রুই যেন তাদের সম্বল। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে এবছর জেলায় বোরো চাষ হয়েছে ৫৩ হাজার ৪শ’ ২৬ হেক্টর জমিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৪শ’ ৩২ হেক্টর। এর মধ্যে হাকালুকির তীরবর্তী কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১২ হাজার ৯শ’ ৩৫ হেক্টর বোরো ফসলের জমি। জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩০ হাজার ৮ শ’ ৩০ জন কৃষক। আর সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ১শ’ ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। হাওর জুড়ে মরেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। মরেছে শামুক, জোঁক, সাপ, ব্যাঙসহ নানা প্রাণী। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে হাকালুকি হাওরে ২৫ হাজার টন মাছ মারা গেছে। এর মধ্যে কুলাউড়া অংশে ৮, জুড়ী অংশে ৭ ও বড়লেখা অংশে ১০ টন মাছ মারা গেছে। কিন্তু কি পরিমাণ জলজ প্রাণির ক্ষতি হয়েছে তা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দূষিত পানিতে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হাকালুকিতে বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা, হলে কি পরিমাণ হয়েছে তা নিয়ে রয়েছেন উদ্বিগ্ন। এখনো হাওর থেকে আসছে উৎকট গন্ধ। জলাবদ্ধতায় হাওরের বিবর্তিত হওয়া লাল ও কালছে পানির রং কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। জেলা মৎস্য বিভাগ পানির গুণগতমান ফেরাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এমন প্রচেষ্টা আর প্রকৃতির সহায়তায় অনেকটা সফলতা আসছে ধীরে ধীরে। গেল ২ দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে পানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সহায়ক হচ্ছে। হাওরের তীরবর্তী কিছু এলাকায় তলিয়ে থাকা বোরো ধান জেগে উঠছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই কৃষকের। কারণ থোড়ওলা ও আধাপাকা এই ধানগুলো দীর্ঘ দিন পানিতে ডুবে থাকায় চাল হওয়া তো দূরের কথা পচা ধান গাছগুলো গো-মহিষের খাদ্যও হচ্ছে না। এই সময় হাওরজুড়ে বোরো ফসল কাটা আর মাড়াইয়ের ধুম পড়ার কথা ছিল। নতুন ধান ঘরে তোলা নিয়ে আনন্দিত কৃষক পরিবারগুলো নবান্ন উৎসবে ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও উল্টো চিত্র। হাকালুকি হাওরে এমন ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই প্রথম। এর আগে এক সঙ্গে এমন বড় বিপর্যয় তারা কখনো দেখেনি। এমনটি বলছেন হাকালুকি হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্তরা। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে এখন বিপর্যস্ত হাকালুকি হাওর পাড়ের মানুষ। পরিবারের জীবিকা চালানোর কোনো উপকরণই আর অবশিষ্ট নেই। তাই চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা।

হাওরের তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, হাকালুকি হাওর কেবল এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর নয়, দেশের সর্ববৃহৎ মিঠা পানির মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। এবছর অকাল বন্যায় ধানের পচনে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে ডিমওয়ালা মা মাছ, পোনা মাছ, হাঁস ও জলজ প্রাণীর মড়ক লেগেছে। ফলে মিঠা পানির এই মৎস্য প্রজননের হাওরটি হুমকির মুখে পড়ছে। হাকালুকির বিল ইজারাদার আনোয়ার হোসেন, আব্দুর রব কামাল, সমছির আলী সহ অনেকেই জানান বিলগুলোতে সরকারের রাজস্বসহ প্রায় কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা। বিলগুলোর সব মাছ মরে সাফ। কি করে ক্ষতি পোষাবেন তা ভেবে দিশাহারা। এদিকে হাকালুকিতে ৩ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ থাকায় প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। বাজার গুলোতে যেমন কম মাছ উঠছে তেমনি দামও চওড়া। তাছাড়া রোগ জীবাণুর ভয়ে মাছের ক্রেতাও কমে গেছে বলে জানালেন স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকার্তা আ.ক.ম শফিক-উজ-জামান ও সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো: সুলতান মাহমুদ জানান গত দু’দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি আর মৎস্য বিভাগ চুন ছিটানোতে হাওরের পানির স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। ৮টি বিলে ১৮ লাখ পোনা নার্সিং করা হচ্ছে জুনের আগে পোনা গুলো অবমুক্ত করা হবে। পোনা মাছ ছেড়ে হাকালুকি হাওরের মাছের ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহাজান বলেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দিচ্ছে কৃষিবিভাগ। ক্ষতি পোষিয়ে উঠতে এবছর আউশ ধান চাষে অনাবাদি ৫ হাজার হেক্টর জমি চাষের আওতায় আনা হচ্ছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=62586&cat=3/