২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৫

হাওরে হাঁসচাষিদের চোখে অন্ধকার

পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ, এনামুল হক, ধর্মপাশা , আল মামুন তালুকদার, মোহনগঞ্জ

এমন বিপর্যয় স্মরণকালেও দেখেনি হাওরবাসী। তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ধান ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। মাছই ছিল কারও কারও অন্যতম ভরসা। তাতেও লেগেছে মড়ক। এখানেই শেষ নয়। হাওরবাসীর জীবন-জীবিকার সর্বশেষ অবলম্বন হাঁসের ওপরেও নেমে এসেছে বিপর্যয়। হাওরে রয়েছে শত শত হাঁসের খামার। এই হাঁস ও হাঁসের ডিম বিক্রি করে হাওরবাসী অনেকে দেখেন সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন। চাষিরা পাঁচশ' থেকে দুই হাজার হাঁস নিয়ে শুরু করেন একেকটি খামার। ধানই ছিল এসব হাঁসের প্রধান খাদ্য। এ জন্য বাজার থেকে খামারিদের বাড়তি দামে হাঁসের খাবার কিনতে হয় না। তা ছাড়া হাওরের শামুক, ঝিনুক, মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী হাঁসের পুষ্টির অন্যতম উৎস। দূষিত পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব জলজ প্রাণী। আর তা খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে হাঁস। এখন ভয় আর আতঙ্কে খামারিরা তাদের হাঁস কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সব মিলিয়ে হাওরের হাঁস চাষিদের চোখে-মুখে অন্ধকার দেখা ছাড়া উপায় নেই।


গতকাল শনিবার দুপুরে কথা হয় হাঁস খামারি জামালের সঙ্গে। তিনি জানান, তার খামারে হাঁস ছিল এক হাজার ৫শ'। খাবার সংকট ও রোগে আক্রান্ত হয়ে হাঁস মরতে পারে এমন ভয়ে ৭শ' হাঁস কয়েক দিন আগে বিক্রি দিয়েছেন। তিনি এই হাঁসগুলো প্রতিটি ৪শ' টাকায় কিনেছিলেন। কিন্তু এখন বিক্রি করেছেন প্রতিটি ২শ' টাকায়। ধর্মপাশা উপজেলার চামরদানি ইউনিয়নের সাড়ারকোনা গ্রামের বাসিন্দা এই খামারি আক্ষেপ করে বলেন, 'আওরে (হাওর) আঁস (হাঁস) মরতাছে হুইন্যা কেউ কিনতো চায় না। এইবার আমরার ফসল নাই। এহন আবার আঁসের ওপরে গজব চলতাছে। যে মাইরে হরছি (পড়েছি), হেই মাইর থাইক্যা কয়েক বৎসরেও উডন যাইতো না।'


উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের চকিয়াচাপুর গ্রামের খামারি মানিক মিয়া জানান, তার এক হাজার ৪শ' হাঁস আছে। রোগে আক্রান্ত হয়ে তার হাঁস মরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, 'ধান না থাহাতে এখন যে অবস্থা শুরু অইছে, তাতে আঁস বেইচ্চা দেওন ছাড়া উপায় নাই। মানুষেরই তো খাওন নাই।'


গতকাল সুনামগঞ্জ শহরে ষোলঘরের মেসার্স আরিফ ফার্মেসিতে হাঁসের ওষুধ নিতে এসেছিলেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বেতকোনার নূর উদ্দিন, বুড়িস্থলের আবদুুল মোমেন, ছাতকের চেচানের চমক আলী। এদের সবার খামারেই হাঁসের মড়ক লেগেছে। নূর উদ্দিন বলেন, 'পয়লা সকালে কাইত অইয়া পড়ি গেছে। এর পরে বিকালে মরি গেছে।' আবদুুল মোমেনের ৯৭০টি হাঁসের মধ্যে গত দু'দিনে ১৭০টি মারা গেছে। চমক আলীর ৪শ'টি হাঁসের মধ্যে ৩০টি মারা গেছে।


নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. তাহের মিয়ার রাজহাঁসের খামার রয়েছে। তার ৫শ'টি হাঁসের মধ্যে গত কয়েক দিনে রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩৫টি হাঁস মারা গেছে। তার বেঁচে থাকা হাঁসগুলোর জন্য প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই মণ ধান প্রয়োজন। হাওরাঞ্চলের কৃষক এবার ধান তুলতে না পারায় প্রতি মণ ৯শ' টাকা দরে ধান কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।


একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম স্থানীয় কুরশিমুল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। সে বেসরকারি সংস্থা থেকে ৬৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি হাঁসের খামার করেছে। তার খামারে থাকা দেড় হাজার হাঁসের মধ্যে ৫শ'টি ডিম দেওয়া শুরু করেছে। রফিকুল ইসলামের মা ছালেমা খাতুন বলেন, 'আমার ছেলে এনজিও থেকে ঋণ তুলে খামার গড়ে তুলেছিল। কিন্তু হাওরের ফসল ডুবে যাওয়ায় ধানের দাম বেড়ে গেছে। তাই বেশি দাম দিয়ে ধান কিনে হাঁসের খাবার দিতে গিয়ে খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছি। ঠিকমতো খাবার দিতে না পারলে ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।'


একই গ্রামের আরেক খামারি হাঁসের ছোট্ট বাচ্চা সংগ্রহ করে তা বড় করে বিক্রি করেন। কিন্তু এবার তিনি হাঁসের দুই হাজার বাচ্চা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। খাদ্য সংকটের কারণে হাঁসের বাচ্চাগুলোর দাম কম হলেও বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি।


সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বেলাল হোসেন বলেন, 'সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় ২৫ লাখ হাঁস আছে। হাঁসে মড়ক লেগেছে- এমন খবর পেয়ে জগন্নাথপুরের দুটি মৃত হাঁস আমরা কেন্দ্রীয় রোগ অনুসন্ধান কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। জেলার কিছু এলাকায় মাইকিং করে বলা হয়েছে দূষিত পানিতে হাঁস না ছাড়ার জন্য। বিভিন্ন উপজেলায় আমাদের ভেটেরিনারি সার্জনরা যে ওষুধ দিচ্ছেন, তাতেও হাঁসের রোগ সারছে।'


বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, 'হাওরের প্রাকৃতিক খাবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে প্রকৃত কারণ বলা কঠিন। হাওরের কচি ধানগুলো যখন পচে যায়, তখন ব্যাকটেরিয়া বেড়ে অ্যামোনিয়া গ্যাসও তৈরি হয়েছে। সেগুলো জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে হাওরের ছোট ছোট প্রাণীগুলোও মরেছে। আর এগুলো খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হাঁস মরছে।'


কেন্দ্রীয় প্রাণিরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, 'সুনামগঞ্জ থেকে দুটি মরা হাঁসের নমুনা শুক্রবার আমরা পেয়েছি। ময়নাতদন্ত করে মনে হয়েছে, হাঁসগুলো কলেরায় আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগ সাধারণত পচনশীল কিছু খেলে হয়। হাঁসের নমুনা আজ আমাদের গবেষণাগারের কালচারাল ইউনিটে দেওয়া হয়েছে। দু'দিন পর চূড়ান্ত ফল জানা যাবে।'


বিশেষজ্ঞদের মতে, অগভীর জলাশয়ে পচনশীল উদ্ভিদ বা মৃত প্রাণী জমা হলে ওই জলাশয়ের পানির নিচের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে অক্সিজেনের অভাবে কীট-পতঙ্গ, শামুক-ঝিনুক, মাছ ইত্যাদি মারা যায়। এসব জীব পচে আবার জীবাণু ছড়ায়। হাঁস সাধারণত কাদামাটিতে খুটে খাবার খাওয়ার ফলে এই জীবাণু হাঁসের অন্ত্রে বিরাজ করে। ফলে হাঁস বটুলিজম রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি ওয়েস্টার্ন ডাক সিকনেস নামেও পরিচিত। ক্লোস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট নিউরোটকসিন এ রোগের প্রধান কারণ। তবে এসব হাঁস বটুলিজম রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে কি-না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বোঝার উপায় নেই বলে জানালেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম।


কয়েক দিন ধরে খামারিরা হাঁসের চিকিৎসার জন্য বেশি আসছে বলে জানালেন ধর্মপাশা উপজেলার স্থানীয় ভেটেরিনারি চিকিৎসক লিটন দাস। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুর রহিম মিয়া বলেন, 'খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে হাওরাঞ্চলের হাঁস কলেরাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।'

http://bangla.samakal.net/2017/04/23/287366#sthash.pa2GnOmY.dpuf