২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:৪১

সরকারের আর্শি বিরোধী দল

দেখা অদেখা

|| সালাহউদ্দিন বাবর ||

বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠা ও কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ ও পরিবেশের বেশ অভাব রয়েছে। ক্ষমতাসীনদের রোষানল এবং অসহিষ্ণুতার কারণে এখানে বিরোধী দলের পক্ষে দায়িত্ব পালন করা কঠিন, অধিকন্তু তাদের নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়।
বাংলাদেশে সব সময়ই লক্ষ করা গেছে, যারাই সরকার গঠন করেছে, তারাই ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্ববাদী হিসেবে সব ক্ষমতাই নিজেদের কব্জায় নিয়ে গেছে।
একটি কার্যকর ও দায়িত্বশীল বিরোধী দল দেশের জন্য অপরিহার্য। রাষ্ট্রযন্ত্র কী হালে চলছে, তা বোঝার ব্যারোমিটার হচ্ছে বিরোধী দল। গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসন কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের আবশ্যকতা নিয়ে বিতর্ক বা দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই বিরোধী দল প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীনদের আর্শি বা আয়না হিসেবে কাজ করে থাকে। সরকার তাদের কর্মকাণ্ডের ভালো ও মন্দ দিকটার প্রতিচ্ছবি বিরোধী দলের বক্তব্য ও সমালোচনার মাধ্যমে দেখতে পায়। ক্ষমতাসীনেরা তা থেকে নিজেদের সংশোধন ও বিন্যস্ত করার সুযোগ পান। তাই বিরোধী দলকে কখনো নিজেদের কল্যাণকামী বিবেচনা করে তাদের প্রয়োজন উপলব্ধি করা এবং তাদের দায়িত্ব পালনকে স্বাগত জানানো উচিত।
তা ছাড়া, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের দায়িত্ব ও মর্যাদা অনেক উচ্চমাত্রায়। তাদের ‘ছায়াসরকার’ বিবেচনা করা হয়। যারা সরকারে থাকেন তারা তাদের প্রতিপক্ষকে কাজ করার জন্য সব রকম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা কর্তব্য।
দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলের এত গুরুত্ব ও প্রয়োজন সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠা এবং কার্যকর ভূমিকা পালনে সুযোগ ও পরিবেশের অনেক অভাব রয়েছে। ক্ষমতাসীনদের রোষানল আর অসহিষ্ণুতার কারণে এখানে বিরোধী দলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা কঠিন। তাদের নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। বাংলাদেশে সব সময়ই লক্ষ করা গেছে, যারাই সরকারে গিয়েছে তারাই ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্ববাদী হিসেবে সব ক্ষমতাকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে গেছে। তবে মাত্রার দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, বর্তমান সময়ে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা অনেক বেশি। যেহেতু বর্তমান জাতীয় সংসদে প্রকৃত কোনো বিরোধী দল নেই, তাই সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জবাবদিহিতাও নেই। বাংলাদেশে ইতিহাসের সূচনাতেই লক্ষ করা গেছে, কোনো সুস্থ এবং দায়িত্বশীল বিরোধী দল ছিল না। সে সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সংসদের বাইরে যে বিরোধী দলের মঞ্চ তৈরি করেছিল, তা সুষ্ঠু এবং ইতিবাচক ধারায় অগ্রসর হয়নি। তারা সমালোচনার জন্য সমালোচনা করেছে। তারা অস্ত্রের ব্যবহার করেছে এবং নানা হঠকারীমূলক পথে অগ্রসর হয়েছে। অপর দিকে তাদের প্রতিহত করা হয়েছে বল প্রয়োগ করে। ফলে গোড়াতেই বিরোধী দল প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একই সাথে সরকার বিরোধী দলের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তাতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল কারোরই সূচনা প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারেনি। এই নেতিবাচক ধারা পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে।
বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে সরকারি দল ও বিরোধী দলের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে দেশের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হয়েছে। সরকার সে সময় বিরোধী দলের বক্তব্য-বিবৃতি এবং কার্যক্রমকে সরকারবিরোধী না ভেবে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে গণ্য করেছে। তাই এর মোকাবেলা করেছে সেভাবেই। অথচ সেই পন্থাটি মোটেও যথোচিত ছিল না। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পর গণ-আকাক্সক্ষা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে নবীন ও অনভিজ্ঞ সরকারের পক্ষে দেশের হাজার সমস্যার সমাধান রক্ষা সম্ভব ছিল না। সরকারের এই অসক্ষমতা, প্রস্তুতিহীনতা এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে জনগণের দুর্ভোগ সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সরকার তখন আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও তেমন পায়নি। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীনেরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকেন। পক্ষান্তরে তখন সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত তরুণদের সমন্বয়ে জাসদ নামে যে বিরোধী দল গঠিত হয়েছিল সে সময় তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, স্বাধীনতা-পরবর্তী বিপুল আকাক্সক্ষা পূরণে সরকারের অক্ষমতায় তারা হতাশ ও ুব্ধ হয়ে যে পথ অনুসরণ করেছিল সেটা ছিল অগণতান্ত্রিক ও হিংসাত্মক।
সরকার ও বিরোধী দলের এহেন কর্মকাণ্ডে দেশের সার্বিক অবস্থা হয়ে পড়েছিল সঙ্গিন। এটাই আমাদের দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট, যাতে কোনো শুভ সূচনার লক্ষণ ছিল না। এর প্রভাবে আজও সে রাজনীতির ধরন পাল্টেনি। এখনো রাজনীতিকেরা নিজেদের ভুল স্বীকার করতে চান না। সেই ভুলের পর্যালোচনা করে আত্মসংশোধনের চেষ্টাও লক্ষ করা যায় না। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নীতি ও আদর্শ নিয়ে মতপার্থক্য এবং নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের পথ ভিন্ন হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা নিয়ে বৈরিতা হতে পারে না, বরং ভুলত্রুটির সমালোচনাকে স্বাগত জানাতে হবে। সরকার ও বিরোধী দল, উভয়কে স্মরণ রাখতে হবে যে, বাড়াবাড়ি কারো জন্যই উত্তম ফল দিতে পারে না। বিজয়ের জন্য ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের বড় বিচারক হলো জনগণ, তাদের সন্তুষ্টির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা কখনোই জনগণের প্রতি তেমন গুরুত্বের সাথে দৃষ্টি দেননি। এটাই জাতির দুর্ভাগ্য।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল, যদিও তারা সংসদে নেই। সংসদে না যাওয়ার পেছনে যে কারণ রয়েছে তার জন্য বিএনপি এককভাবে দায়ী নয়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, তাদের দাবি ছিলÑ গণতন্ত্রের স্বার্থে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং তেমন নির্বাচন হলেই তারা অংশ নেবেন। সে দাবির পক্ষে তারা বলেছিলেন, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজন। অতীতে আওয়ামী লীগও এমন দাবিতে নির্বাচন বর্জন করেছে। ২০১৪ সালে এই দাবি অগ্রাহ্য হলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করার পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। অতীতে এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে, একটিও অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। পক্ষান্তরে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সেগুলো অপেক্ষাকৃত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এ দাবিতে বিএনপি এখনো অনড় এবং এ জন্য তারা আন্দোলন করে যাচ্ছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগে এই দাবিতে আন্দোলন করেছে এবং তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিধান করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ক্ষমতায় গিয়ে তারাই এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এরপর তাদের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে, সে নির্বাচন ছিল প্রহসনমূলক। নির্বাচনের যে ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য, তা তাতে ছিল না। তাই দেশের ভেতরে ও বাইরে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এখনো দেশে ও দেশের বাইরে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি রয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচনের সংস্কৃতিতে যে ঐতিহ্য লক্ষ করা যায়, তাতে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার যে গণতান্ত্রিক চেতনা, তার বড়ই অভাব। আর তাই অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কারা জনগণের সুস্পষ্ট রায় পেলেন আর সংসদে কারা বিরোধী দলের আসনে বসবে তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ব্যাহত হয়। এর অশুভ প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এখন সংসদে যারা নিজেদের বিরোধী দল বলে কখনো কখনো দাবি করেন, প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলের সংজ্ঞায় তারা পড়ে না। এই দলের যিনি নেতা সেই এরশাদ মন্ত্রীর মর্যাদায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে আছেন। এই দলের একাধিক সদস্য সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য। বিভিন্ন সময়ে জনাব এরশাদের বক্তব্য নিয়ে যদি বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যাবে, সেসবের কী অর্থ দাঁড়ায়। সম্প্রতি তিনি অন্তত দুই দফা বলেছেন, আগামীতে আওয়ামী লীগ ও তার দল মিলেমিশে দেশ চালাবে। অতিসম্প্রতি তিনি জনগণের উদ্দেশে আবার বলেছেন, তিনি রাষ্ট্র চালাতে সক্ষম, আরেকবার দেশ চালাতে তাকে ভোট দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। এমন অর্থহীন বক্তব্যই তিনি দিয়ে থাকেন। এই ‘সরকারের সুহৃদ’ হিসেবেই জনগণ তাদের বিবেচনা করে থাকে। তাই জনগণ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল মনে করে না। তারা সে ভূমিকা পালনও করে না।
বিএনপিকে সরকার দীর্ঘ দিন দারুণ চাপের মধ্যে রেখেছে এবং নানা দিক থেকে বিপদগ্রস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রথমত দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বহু মামলা করে রেখেছে। এতে তারা হয়রানির শিকার হওয়াসহ মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। বানানো মামলায় জড়িয়ে তাদের দলের জন্য কাজ করা থেকে বিরত রাখাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য। বিএনপিকে নানা দিক থেকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সরকার সমর্থক মিডিয়া অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ বিএনপির ভাবমর্যাদা ুণœ করা, জনসমক্ষে হেয় করা। বিএনপিকে গণবিচ্ছিন্ন করা এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে না দেয়ার জন্য তাদের সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। একটি রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। অথচ সরকার এই বিরাট দলটিকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখার জন্য প্রশাসন এবং বিভিন্ন বাহিনীকে ব্যবহার করছে। এসব বাধা অতিক্রম করে বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে গেলে নানাভাবে হয়রানির ব্যবস্থা করা হয়। বিএনপির মনোনয়নে যারা বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীনেরা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তাদের স্বপদ থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত এই নেতারা আইনের আশ্রয় নিয়ে আদালত থেকে ক্ষমতায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাচ্ছেন। তারপরও তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। এসব হয়রানির কারণ হচ্ছে, বিএনপির নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলে জনগণ তাদের আবারো নির্বাচিত করতে পারে। সরকারপক্ষ এই সুযোগ দিতে নারাজ। অথচ এমন ধারার রাজনীতি সরকারের জন্য অকল্যাণ ডেকে আনছে। দেশে ও দেশের বাইরের কেউ গণতন্ত্রের এমন করুণ দশাকে সমর্থন করেন না।
গণতন্ত্রের পথ ধরে চলতে গেলে যে ভারসাম্যের দরকার হয়, তা ব্যতিরেকেই এখন সব কিছু করা হচ্ছে। জাতীয় বহু ইস্যু নিয়ে আলোচনার বৃহত্তর ফোরাম হচ্ছে সংসদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন। এ নিয়ে পত্রপত্রিকাসহ নানা ফোরামে তুমুল আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু সংসদে কোনো আলোচনা নেই। আর সংসদ থেকে এমন আলোচনা অনুষ্ঠানের দাবিও আসছে না। অথচ বিষয়টির গুরুত্ব অনেক।
নিয়ম রয়েছে, সরকার কোনো দেশের সাথে সমঝোতা বা চুক্তি করলে জরুরিভাবে তা সংসদে পেশ এবং উন্মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সংসদ থেকে যেমন আলোচনার কোনো দাবি আসেনি, তেমনি সরকারেরও এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই প্রক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে গেলে দেশের যারা প্রকৃত মালিক সেই বৃহত্তর জনগণ কিভাবে জানবে, দেশ নিয়ে বা তাদের ভাগ্য নিয়ে সরকার কী করছে। সংসদের মতো প্রকৃত ফোরামে এই আলোচনা হলে গোটা দেশবাসী তা জানতে পারত। তারা বুঝত, তাদের প্রতিনিধিরা কতটুকু, কী করছে এবং স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতার স্বরূপটা কী।
তবে ভারত সফর নিয়ে বিএনপির ভূমিকাকে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ফলাফল নিয়ে কেউই সন্তুষ্ট নয়। অপ্রাপ্তিজনিত হতাশায় সবাই ভুগছে। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করে দেশে ফিরে হতাশার সুরে বলেছেন, পানি চাইলাম, পেলাম বিদ্যুৎ। তা-ও তো কিছু পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপ নিয়ে নানা বক্তব্য এসেছে। এতে সফরের প্রকৃত ফলাফল যে হতাশাজনক, তা পরিষ্কার হয়েছে। সম্ভবত যে কারণেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, জাতীয় মানমর্যাদার সাথে সম্পৃক্ত আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন আইপিইউ নিয়ে বিএনপি নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রেখেছে। একই কায়দায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসূ ভারত সফরকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এই সফর ছিল অত্যন্ত কার্যকর, ফলপ্রসূ এবং পুরো জাতির জন্য মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে এই সফর সম্পর্কে ভিত্তিহীন ও অন্তঃসারশূন্য বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য উত্থাপন করেছেন বলে কাদেরের অভিযোগ। বিএনপি নানাভাবে এই সফর নিয়ে কথা বলে আসলে বিরোধী দলের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ সফরের ফলাফল নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে ভারতের সাথে সম্পাদিত চুক্তির ভালো-মন্দ বিচার ও পর্যালোচনা করবেন। এ ছাড়া বিএনপি নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা ছিল। ভারত তিস্তার পানি একতরফাভাবে তুলে নেয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অভিন্ন নদীর পানি সঙ্কটের ফলে অতীতে বিভিন্ন সরকারের মতো বর্তমান সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। বর্তমান আমলে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে দিয়েছে কিঞ্চিৎ। দেশের জনগণের ওপর এর হতাশাব্যঞ্জক ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে সরকারের সমালোচনায় বিএনপি যেমন তাদের দুয়ারে আঘাত করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে তারা সফল হয়েছে। এই নির্বাচনের ফলাফল বিএনপির জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। জনগণের সমর্থনে দলটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়। তাদের ভাবমর্যাদাকে বাড়িয়ে তুলতে এবং দলের নেতাকর্মীদের মনোবল উচ্চকিত করতে সমর্থ হয়। এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, তারা জনগণকে তাদের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কর্মী-সমর্থকদের কারচুপি করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়েছে। তা ছাড়া তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনিয়ম করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছে। নির্বাচন কমিশন যাতে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে, সে জন্যও বিএনপি প্রয়াস চালিয়েছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অপরাপর শক্তিকেও সুশৃঙ্খল ভূমিকা পালন করতে হয়। বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা সে শৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে হেরে গেলেও বিএনপির এই নির্বাচন থেকে অর্জন কম নয়। তারা ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। সে জন্য নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি যে ভোট পেয়েছে তা থেকে তারা বুঝতে সক্ষম, তাদের জনসমর্থন কোন পর্যায়ে আছে। ভবিষ্যতে এখানে নির্বাচনে বিজয়ী হতে তাদের কোন কৌশল গ্রহণ করতে হবে, তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে।
বিএনপির বেশ কিছু দুর্বলতাও রয়েছে, যা দলটির এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। যেমন, সংহতির অভাব, অন্তঃকোন্দল, নেতাকর্মীদের স্থবিরতা এবং দলের জন্য আত্মত্যাগের মানসিকতার ঘাটতি। বিএনপি প্রতিপক্ষ দলের বড় একটি সহযোগী বাহিনী হচ্ছে কবি, লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। তারা দলের সম্মুখভাগে থেকে সংগঠনকে বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেন। এই বলয়ের সাংবাদিক লেখক বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে চিন্তাভাবনা ও কর্মসম্পাদন করেন, সে তুলনায় বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা অনেক পিছিয়ে। বিএনপির রাজনীতিতে প্রযুক্তি ব্যবহার ও গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। দলের নীতি ঠিক করা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি উপলব্ধি এবং নিজেদের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য আজকের যুগে বাংলাদেশের প্রথম কাতারের দলগুলোকে গবেষণা ও প্রযুক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রায় সব দলেরই একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছেÑ দলের ভেতর শৃঙ্খলার অভাব এবং গণতন্ত্রের চর্চা না করা। এই দুই সমস্যা বিএনপিরও রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেছে, দলের সিদ্ধান্ত কার্যকর এবং ওপরের নির্দেশ মান্য করার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে, যা দলের সংহতি ও শ্ঙ্খৃলার জন্য ক্ষতিকর। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায়, বিএনপির প্রতিপক্ষ শক্তির আন্তর্জাতিক বন্ধু বা সুহৃদের সংখ্যা অনেক। পক্ষান্তরে বিএনপির সে পরিমাণ সুহৃদ নেই। বাংলাদেশ এখন এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে এর গুরুত্ব সমধিক। তাই আন্তর্জাতিক বলয়ে কিভাবে কাজ এবং সফলতা অর্জন করতে হবে সেটা নিয়ে চিন্তার ঘাটতি থাকলে হবে না। এটা বিএনপিকে উপলব্ধি করতে হবে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি আসেন, তারা এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের যে দূতরা রয়েছেন তারাও বিএনপির চেয়ারপারসনের সাথে সাক্ষাৎ করে থাকেন। এ থেকে প্রধান বিরোধী দলের গুরুত্বই ফুটে ওঠে। আর একটি ক্ষেত্রে বিএনপির পদচারণা নেই, সেটা হলো শিল্প সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক বলয়। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং কাছে টানার ক্ষেত্রে শিল্প সংস্কৃতির ভূমিকা অনেকখানি। কিন্তু এই বলয়ে বিএনপির আজও উপস্থিতি নেই বললেই চলে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/214252