২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৯

চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ পাঁচ কারণে বেসামাল


দরপত্রের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনা এখন তুচ্ছ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করা, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়া, পরীক্ষা পণ্ড করে দেওয়া এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে গন্ডগোল বাধানো। একের পর এক এ রকম নানা নেতিবাচক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছেন চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এমন বেপরোয়া আচরণের জন্য পাঁচটি সুনির্দিষ্ট কারণের কথা বলছেন সংগঠনটির বর্তমান ও সাবেক নেতারা।
পাঁচটি কারণের মধ্যে রয়েছে, সংগঠনের প্রতি নেতা-কর্মীদের আদর্শিক আনুগত্য না থাকা, অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা, অনুপ্রবেশ (ভিন্ন সংগঠন থেকে ছাত্রলীগে যোগদান) এবং দীর্ঘদিন ধরে দল ক্ষমতায় থাকায় কেউ কিছু করতে পারবে না এমন মনোভাবের সৃষ্টি হওয়া।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী বলেন, কিছু নেতা-কর্মী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে।
গত এক সপ্তাহের মধ্যে ছিনতাই, ছাত্রী উত্ত্যক্ত করা, পরীক্ষা পণ্ড করে দেওয়া এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ—এমন চারটি ঘটনার জন্ম দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলের প্রতি ন্যূনতম আনুগত্য থাকলে কারও পক্ষে ছিনতাই ও ছাত্রী উত্ত্যক্তের মতো ঘটনায় জড়ানো সম্ভব নয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রলীগকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁর মতে, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বাছ-বিচার ছাড়াই বিভিন্নজনকে ছাত্রলীগের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ।
গত বছরের অক্টোবর থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে ছাত্রলীগের ১৬ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আট নেতাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে।

বারবার সংঘর্ষের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দলীয় বিভক্তির কারণে অনেক ঘটনায় জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে বিশৃঙ্খলা থামানো যাচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগেও চলছে বিশৃঙ্ক্ষলা। পয়লা বৈশাখ নগরের ডিসি হিলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার জন্য বসানো আর্চওয়ে দিয়ে না ঢুকে জোর করে ভিন্ন পথে ঢোকার চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ছোড়া ইটের আঘাতে পুলিশের এক সদস্যের মাথা ফেটে যায়। অথচ ওই অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ কষ্ট করে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে শৃঙ্খলা মেনে ডিসি হিলে প্রবেশ করে। এ ছাড়া গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরের আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিংপুল নির্মাণ বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ।

বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মীরা যা করেছেন, তা ঠিক হয়নি বলে স্বীকার করেন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম। তাঁর দাবি, কেউ অপকর্ম করলে তাঁকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম নগর ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দুটি ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষ নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। অন্য পক্ষ নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। দুই নেতার অনুসারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুদিন পরপর সংঘর্ষের ঘটনাও প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে।
নগরের চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে তিন দশক পর ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পায় ছাত্রলীগ। এরপর থেক কলেজ দুটিতে কেবল মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা রাজনীতি করার সুযোগ পান। পরে আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামের অনুসারীরাও কলেজে সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। তিন পক্ষই ‘সক্রিয়’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করায় গত এক বছরে সেখানে অন্তত সাতবার সংঘর্ষ হয়েছে।
ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণের শিকার হতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাদেরও। গত বছরের ১৯ নভেম্বর লালদীঘি ময়দানে এক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। এ ঘটনায় নগরের ওমরগণি এম ই এস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের চার নেতাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ।

গত ১৫ মাসে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্তত ৩০ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। খুন হয়েছেন তিনজন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬৫ জন।
ছাত্রলীগ কেন বেসামাল হয়ে উঠেছে, তা জানতে চাইলে চট্টগ্রামের প্রবীণ অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নানা সময়ে নানা কিছু করে পার পেয়ে গেছেন। দলীয় কোন্দল থাকায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, তাঁরা যা-ই করুন না কেন, কেউ না কেউ তাঁদের উদ্ধার করবে। আর নেতৃত্বের নৈতিক স্খলন হয়েছে। চেইন অব কমান্ড নেই। ফলে নেতা-কর্মীরা বেপরোয়া হলেও তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1153696