২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৭

ভেঙে গেছে ৫২টি বেড়িবাঁধ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

হাওরাঞ্চলে মাছের পর এবার হাঁসে মড়ক * পানির দরে গরু ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছেন বাসিন্দারা * সুনামগঞ্জে দুর্যোগ ও ত্রাণ সচিবের প্রত্যাহার দাবি

শনির দশা যেন পিছু ছাড়ছে না হাওরাঞ্চলের বাসিন্দাদের। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হয়ে চোখে-মুখে এখন অমানিশার ঘোর অন্ধকার দেখছেন তারা। পানিতে সোনালি ফসল তলিয়ে গেছে। পচা ধানের বিষাক্ত গ্যাসে মারা গেছে চাষের মাছ। এবার মড়ক লেগেছে খামারের হাঁসে। গোখাদ্যের সংকটে অনেকে পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন গরু-ছাগল। গত কয়েকদিনে কয়েক হাজার হাঁস মারা গেছে। বৃহস্পতি ও শুক্রবারের বৃষ্টিতে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় নতুন করে ৫২টি বেড়িবাঁধ ভেঙে ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ আধাপাকা বোরো ফসলের জমি।

এদিকে সুনামগঞ্জের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামালের চরম কটাক্ষমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে এবং মন্ত্রণালয় থেকে তাকে দ্রুত প্রত্যাহারের দাবিতে ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধন হয়েছে। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কিশোরগঞ্জ : বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দিনভর তাড়াইল উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ছোট-বড় ৫২টি বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এতে অন্তত ১০ সহস াধিক হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। সাচাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মহাজন জানান, শুধু তার ইউনিয়নেই ১১টি বাঁধ ভেঙে আড়াই সহস াধিক হেক্টর জমি ডুবে যায়। জাউয়ার ইউনিয়নের কৃষক শাহজাহান মিয়া জানান, তিনি এবার ৩২ একর জমিতে বোরো ফসল করেন। এখান থেকে প্রায় আড়াই হাজার মণ ধান পাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু এক ছটাক ধানও তিনি ঘরে তুলতে পারেননি।
উলিয়ার হাওর এলাকার কৃষক রমজান আলী জানান, ওই এলাকার কয়েক হাজার কৃষক মিলে গত চৈত্র মাস থেকে মাটি কেটে, বালির বস্তা ফেলে এবং খড়-বিছালি দিয়ে উলিয়ার হাওর বাঁধটি রক্ষা করে আসছিলেন। প্রতিদিন তারা রাত জেগে পাহারা দিতেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে প্রচণ্ড বজ পাত ও ঝড়ের কারণে তারা পাহারা দিতে পারেননি। এ সময় বাঁধটি ভেঙে ৫ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমি পানিতে ভেসে যায়।

উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা আক্তার ৫২টি বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি ঊধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর ও ছাতক : কাঁচা পচাধানের গ্যাসজনিত কারণে মাছে মড়কের পর এবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাঁস মারা যাচ্ছে। জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জে হাঁস মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জগন্নাথপুরে একটি খামারে প্রায় ৪ হাজার হাঁস মারা যায়। এ নিয়ে খামারিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, হাঁস মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ‘সিলেট আঞ্চলিক রোগ গবেষণা কেন্দ্রে’ নমুনা সংগ্রহের জন্য পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বুধবার দক্ষিণ সুনামগঞ্জে মারা যাওয়া হাঁসের পোস্টমর্টেম হয়। এতে দেখা যায়, ডায়রিয়ায় হাঁসের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার হাঁসের মড়ক ঠেকাতে সদর উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার ডোজ ভেক্সিন দেয়া হয়েছে।
মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, পচে যাওয়া ধান থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস জন্ম নেয়ায় বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, বিশাল হাওর এলাকায় ওষুধ ছিটিয়ে মাছরক্ষা সম্ভব নয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শুক্রবার সুনামগঞ্জে মাছের মড়ক অনুসন্ধানে আসেন। তারা বিভিন্ন হাওরের পানি পরীক্ষা শেষে জানিয়েছেন, বেশির ভাগ হাওরে এখনও অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেশি আছে। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরের পানি এখনও ভালো আছে। আক্রান্ত হাওরের মাছ খেলে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে এ জন্য হাওরের মাছ ধরা ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তারা।
ত্রাণ সচিবকে প্রত্যাহারের দাবি : এদিকে সুনামগঞ্জের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামালের চরম অপমানকর, উপহাসমূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে ও মন্ত্রণালয় থেকে তাকে দ্রুত প্রত্যাহারের দাবিতে ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধন হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে শহরের আলফাত স্কয়ারে (ট্রাফিক পয়েন্ট) অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, কৃষক, ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যমকর্মীরা অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২-এর ২২ ধারার কোনো উপধারায় দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কোনো শর্তের কথা উল্লেখ নেই। তারা দ্রুত সচিবের প্রত্যারের দাবি জানান।
এদিকে প্রশাসন জানায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম আগামী এক সপ্তাহের জন্য সুনামগঞ্জের হাওর জলাশয়ে (যেসব স্থানে মাছে মড়ক লেগেছে) সব ধরনের মাছধরা নিষিদ্ধ করেছেন।

মদন (নেত্রকোনা) : মদনে ছোট-বড় ২৫টি বিল ও হাওরে নতুন করে পানি ডুকে পড়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত এসব বিল ও হাওরে দুই ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিল, পাতুনিয়ার হাওর, বিয়াসীর সামনের হাওর, জালিয়ার হাওর, গণেশের হাওর, ধান কুনিয়ার পেছনের হাওর, বালালীর সামনে তলার হাওর, কুলিয়াটির ছয় বুরিয়া হাওর, হাতির বিল রূপসীর হাওর, দীঘার বিল, ঘোড়া দীঘার হাওর, মহরির বিল, হুহুন বিল, স্লুইসগেটের ভেতরের হাওর, হিংগা বিল, বারুক বিল, হুন্দা বিলে নতুন করে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত উপজেলার ৮ ইউনিয়নে ১৬ হাজার কৃষক পরিবারের ৭ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমির ইরি-বোরো ধান তলিয়ে গেছে। তবে কৃষকদের অভিযোগ, সরকারিভাবে যে পরিমাণ ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভুয়া। কৃষি বিভাগের লোকজন সরেজমিন জরিপ না করেই তাদের মনগড়া তালিকা তৈরি করছেন। তাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য এ এলাকাটিকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানান তারা। এদিকে কৃষদের এ দুরবস্থার মধ্যে হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এলাকাগুলোতে গোখাদ্যেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। খুবই কম মূল্যে কৃষক গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছে। এর মধ্যে দাদন এনজিও ঋণের চাপে অধিকাংশ কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় হাওরের বোরো ধানের ওপর কৃষকরা যেমন নির্ভরশীল, তেমনি বাড়ির গরুর এক বছরের খাবারের ব্যবস্থাও হয় এই ধানের খড় থেকে। কিন্তু এবার ফসল গেছে, সেই সঙ্গে গেছে গোখাদ্যও। ফলে হাওরপারের মানুষ এখন বিপাকে পড়েছেন গবাদিপশু নিয়ে। অনেকে পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন গরু-ছাগল।
কৃষক আইন উদ্দিন জানান, শুধু গোখাদ্যের সংকটের কারণে তিনি তিনটি গরু ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। অথচ হাওরে ফসলহানি না ঘটলে এবং গোখাদ্যের সংকট না থাকলে এই তিনটি গরু লাখ টাকার ওপরে বিক্রি করতে পারতেন।
মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপুতা হাওরে স্থানীয় কৃষক শাহনেওয়াজের ১৯ একর জমি ছিল। জমির সব ধান তলিয়ে গেছে। ধান তুলতে না পারায় কোনো খড়ও পাননি। তার ৫টি গরু আছে। চারটি পাঠিয়ে দিয়েছেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। আরেকটি বিক্রির চেষ্টা করছেন। তবে দাম কম ওঠায় বিক্রি করতে পারছেন না।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১৫ লাখ পাঁচ হাজার গবাদিপশু আছে। হাওরে ফসলহানির পর গোখাদ্যের সংকট দেখা দেয়ায় ৩ লাখ ৮ হাজার ৭৭৬ মেট্রিক টন খড় কেনার চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
গোলাপগঞ্জ (সিলেট) : পানি কিছুটা নেমে যাওয়ার পর ধান পচে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চুন ও ওষুধ ছিটানো হয়। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। বৃহস্পতি ও শুক্রবার বৃষ্টির ফলে ওষুধগুলো ভেসে যায় পানিতে। বাঘা এলাকাবাসী জানান, শীলাকুড়ি, বাছাতইল বাঁধ দিয়ে শাঁ শাঁ করে পানি ঢুকছে। বাঁধটি অনেক নিচু হওয়ায় বাঁধের ওপর দিয়ে সহজেই বন্যার পানি ঢুকে পড়ছে। এ কারণেই কৃষকদের শুধু এ দুটি হাওরে প্রায় ১৬শ’ একর ক্ষেতের ফসলের জমি ও মাছ ভেসে যায়। এ ছাড়া হাকালুকি হাওরের অবস্থাও একই। বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট।
বড়লেখা : হাকালুকি হাওরে চুন প্রয়োগের ফলে পানির গুণাগুণ অনেকটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মঙ্গলবার থেকে মৎস্য বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে হাকালুকি হাওরের পানি দূষণমুক্ত করতে ও মাছের মড়ক রোধে চুন ছিটানো শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৫ টনেরও বেশি চুন ছিটানো হয়েছে।
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) : গৌরীপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার নিন্মাঞ্চলের বোরো ফসলের মাঠ তলিয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার দিনভর ভারি বর্ষণে প্রায় ৫শ’ কৃষকের ৪৮৪ একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাওহা ইউনিয়নের বাউশালী বিলের কৃষকরা তাদের জমির ফসল রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে। তাদের দাবি, সুরিয়া নদীতে খনন না করায় তলিয়ে যাচ্ছে তাদের স্বপ্নের ফসল। শংকিত কৃষক আধাপাকা ধানই কেটে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/22/119205