২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৫

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা :

১৪ বছরে ব্যয় করা ৩০৪ কোটি টাকা জলে

পাউবোর আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে চেয়ে আছে চসিক


চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে ব্যয় হয়েছে ৩০৪ কোটি টাকা। এরপরও এ সমস্যা থেকে মুক্তি পায়নি নগরবাসী। উল্টো সমস্যা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে টাকা ব্যয় হওয়ায় সমস্যার সমাধান হয়নি। বলতে গেলে টাকাগুলো জলেই গেছে।

এদিকে বহদ্দারহাট-সরাইপড়া নতুন খাল খননের জন্য ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেয়া হলেও এখনও টাকা পাওয়া যায়নি। তবে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে নদীর তীরে দেয়াল নির্মাণ, স্লুইসগেট নির্মাণ, খাল খনন ও ড্রেজিংসহ নতুন করে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তাকিয়ে আছে ওই প্রকল্পের দিকে। তবে কবে নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, জলাবদ্ধতার ভয় নগরবাসীকে বছরের পর বছর তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বর্ষা শুরু হলেই নগরবাসীর বুকে কাঁপন ধরে। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর নিন্মাঞ্চলে হাঁটু থেকে কোমর পানি জমে রাস্তাঘাট এবং বাসাবাড়ি ডুবে যায়।

১৪ বছরে ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয় : নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ব্যয় করেছে ৩০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০০৩-০৪ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা, পরবর্তী মেয়র এম মনজুর আলম ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। এরপরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি। বলা হচ্ছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় করা এই টাকা জলেই গেছে। শুক্রবারের সর্বশেষ জলাবদ্ধতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল মেয়র ও কর্পোরেশনের প্রতি নানা কটুমন্তব্য। এই মাধ্যমেই ক্ষোভ ঝেড়েছেন ভুক্তভোগী ও সচেতন নগরবাসী। মেয়র ও সংশ্লিষ্টদের আশ্বাসে আর বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ।

আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প : নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার চসিকের সাধারণ সভায় জানিয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকাকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- কর্ণফুলী নদীর তীরে দেয়াল নির্মাণ, ২৫টি খাল ড্রেজিংকরণ এবং খালের মুখে পাম্প হাউসসহ স্লুইসগেট নির্মাণ। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা স্থায়ীভাবে নিরসন হবে। এছাড়া ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব থোক ও রাজস্ব বরাদ্দ থেকে প্রায় ১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার খাল খনন ও ড্রেন থেকে মাটি উত্তোলন ও অপসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রধান দুই কারণে জলাবদ্ধতা : সিটি কর্পোরেশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরীতে প্রধানত দুই কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর একটি হল- নগরীর সব ক’টি নালা ও খাল বেদখল। অপরটি দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অতিবৃষ্টিতে কর্ণফুলী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি চাক্তাই খাল, ডোম খাল, হিজড়া খাল, মির্জা খাল, শীতল ঝর্ণা খাল, বামুননয়া হাট খাল, গুলজার খাল, বীর্জা খাল, ইছান্যা খাল, মাইট্টা খাল, লালদিয়ারচর খাল, ত্রিপুরা খাল, নাছির খাল, গয়না ছড়া খাল, কাট্টলী খাল, চশমা খালসহ ১৭টি খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব খাল একশ্রেণীর দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে নালায় পরিণত হয়েছে। যে কারণে স্বাভাবিক পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীর ২৫টি খালের আশপাশে বসবাসকারীরা খাল ভরাট করে ভবন ও দোকানপাট নির্মাণের পাশাপাশি খালগুলোকে ব্যবহার করেছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন হিসেবে। ফলে এগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া দ্রুত নগরায়ণের ফলে নগরীর অভ্যন্তরে বিদ্যমান জলাশয়, ডোবা, নালা, পুকুর ভরাট করে ফেলায় নগরীর রাস্তা ও নালা একাকার হয়ে গেছে। এতে বৃষ্টির পানি রাস্তা দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, ‘খাল-নালা একদিকে পরিষ্কার করে না আসতেই পুনরায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে পানি চলাচলে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পেতে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী নভেম্বর থেকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাষ চন্দ্র বড়–য়া যুগান্তরকে বলেন, এ পর্যন্ত যেসব মেয়র সিটি কর্পোরেশনে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের কেউই পরিকল্পনা মোতাবেক টাকা ব্যয় করেননি। যার কারণে যে অর্থ জলাবদ্ধতার নামে ব্যয় হয়েছে তা জলেই গেছে।