২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:৩৩

মামলার খড়গ থামছে না

চার শতাধিক জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত

মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা ও বরখাস্তের খড়গ নামছে দেশের বিভিন্ন স্থানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর। গ্রেফতার করে কারারুদ্ধও করা হচ্ছে অনেককে। ফলে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও জনগণের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছেন না দেশের বিপুল জনপ্রতিনিধি। রাজনৈতিক মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। এতে এক দিকে যেমন সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্য দিকে ব্যাহত হচ্ছে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য। বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন মামলায় বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত এসব জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ভাইস চেয়ারম্যান এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর রয়েছেন। এভাবে বরখাস্ত অব্যাহত থাকলে জনগণ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আগ্রহ হারাবে বলে মনে করেন নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা।


স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বিভিন্ন মামলায় তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে আরো প্রায় ১০০ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হন। এদের অনেককে কারারুদ্ধ করা হয়। অনেকে এখনো কারান্তরীণ রয়েছেন। তবে বরখাস্তকৃতদের অনেকে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে দায়িত্ব ফিরেও পেয়েছেন। দায়িত্ব ফিরে পেলেও অনেকেই চেয়ারে বসতে পারছেন না।


গত ৩০ মার্চ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে ১১ হাজার ভোটে পরাজিত করে দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন কুমিল্লা দণি জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি মামলার জালে আটকে যেতে পারেন, গেজেট-শপথ হলেও আদৌ চেয়ারে বসতে পারবেন কিনা, গ্রেফতার হতে পারেন যেকোনো সময় জনমনে এমন আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। নির্বাচিত হওয়ার ১৯ দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার সাক্কুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার একটি আদালত। একই সাথে তার মালামাল ক্রোকের আদেশও দেয়া হয়।
এর আগে বিপুল ভোটে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল রাজশাহীর মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ২০১৫ সালের ৭ মে তাকে বরখাস্ত করে সরকার। প্রায় ২০ মাস পর উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২ এপ্রিল দায়িত্ব নেয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় আবারো তার হাতে নতুন করে বরখাস্তের আদেশ আসে। এর পর উচ্চ আদালত তার বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করলে তিনি দায়িত্ব নেন।


জনগণের সমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু তিনি বেশি দিন নগরবাসীর সেবা করার সুযোগ পাননি। বোমা হামলার একটি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দীর্ঘ ২৭ মাস আইনি লড়াই চালিয়ে তিনি মেয়রের পদ ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই আবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয় আরিফুল হক চৌধুরীকে। তিনিও একইভাবে উচ্চ আদালতের দারস্থ হয়ে সুরাহা পান।
২০১৩ সালের ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আজমত উল্লাহর চেয়ে সোয়া লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এম এ মান্নান। নির্বাচনের দেড় মাস পর ১৮ আগস্ট তিনি দায়িত্ব নেন। কিন্তু ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি একটি নাশকতার মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ১২ মাস ১৮ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ২ মার্চ তিনি মুক্তি পান। ৪২ দিনের মাথায় ১৫ এপ্রিল আবার গ্রেফতার হন তিনি। ৮ মাস ২২ দিন কারাবন্দী থাকার পর এ বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় মুক্তি পান। নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র এম এ মান্নান দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৮ মাস। আর জেলে কাটিয়েছেন ২২ মাস। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৯টি। সরকার তাকে দুই দফায় সাময়িক বরখাস্ত করেছে। সম্প্রতি তিনি কারামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এখনো মেয়রের চেয়ার ফিরে পাননি।
২০১৩ সালের ১৫ জুন ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন খুলনা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি। নাশকতার দুইটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর মনিরুজ্জামানকে বরখাস্ত করে সরকার। উচ্চ আদালতের আদেশে মেয়রের পদ ফিরে পেলে দীর্ঘ এক বছর ১৯ দিন পর আবার মেয়রের চেয়ারে বসার সুযোগ পান মনিরুজ্জামান মনি।


শুধু সিটি করপোরেশনের মেয়রই নয়, রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকায় সরকার বিএনপি-জামায়াতের সমর্থিত প্রায় ৪০০ উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরমেয়র, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এদের অনেককে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার অনেককে নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নেয়ার সুযোগও দেয়া হয়নি। শপথ নিতে গেলে পথিমধ্যেই তাদের আটক করা হয়। অনেকে জেল খেটে বের হয়ে আবার দায়িত্ব নিতে গেলে আবার বরখাস্ত করা হয়েছে।


জানা যায়, বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যেকোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালত কর্তৃক চার্জশিট গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় ঘটা নাশকতা ও বোমাবাজির ঘটনায় বহু জনপ্রতিনিধিকে আসামি করে মামলা করা হয়। এসব মামলা তদন্ত শেষে পাঁচ শতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা শুরু হয়।


বগুড়ার গাবতলীর মেয়র থাকাবস্থায় ২০১৩ সালের নাশকতার মামলার চার্জশিট হওয়ায় চেয়ারম্যান মোর্শেদ মিল্টনকে বরখাস্ত করা হয়। আদালতের মাধ্যমে চেয়ার ফিরে পেলেও গত বছরের আগস্টে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে ফেরারি হন তিনি। এ সুযোগে উপজেলা পরিষদের পরপর তিনটি বৈঠকও করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ৩ বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার বিষয় নিশ্চিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেন তিনি। এ কারণে এ উপজেলা চেয়ারম্যানকে আবারো সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।


২০১৩ সালে গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায় সাতীরা পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক তাজকিন আহমেদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়। এ কারণে দায়িত্ব নেয়ার আড়াই মাসের মাথায় তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিনাজপুরে ১৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩, সাতীরায় ১৮, কক্সবাজারে ১৯, বগুড়ায় ২৭, রাজশাহীতে ১৭, কুষ্টিয়ায় ১১, চট্টগ্রামে ১৯, পাবনায় ১২, সিরাজগঞ্জে ৭, গাইবান্ধায় ২৪, রংপুরে ২৩, পিরোজপুরে ৪, হবিগঞ্জে ৭, নাটোরে ৯, জয়পুরহাটে ৫, ঠাকুরগাঁওয়ে ৮, পঞ্চগড়ে ৬, খাগড়াছড়িতে ৩, বান্দরবানে ৪, চাঁদপুরে ৪, ময়মনসিংহে ৩, শরীয়তপুরে ১, নড়াইলে ১, সিলেটে ২ জন এবং মাগুরায় একজন রয়েছেন।


স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর একজন জনপ্রতিনিধি যদি অপরাধ করেন তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় কেউ চার্জশিটভুক্ত আসামি হলে বরখাস্ত হওয়া মানে ওই এলাকার মানুষকে শাস্তি দেয়া। এভাবে গণবরখাস্তের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। স্থানীয় সরকারের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা নষ্ট হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ুণœ হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জনগণের রায়ে তারা নির্বাচিত হয়েছেন। তারা যদি অপরাধী হন তাহলে ভিন্ন কথা। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তারা যদি এভাবে বহিষ্কার হন তাহলে জনরায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/214083