২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৭:৪১

হাওরে ঘরে ঘরে অভাব : কাজের সন্ধানে বাড়ী ছাড়ছে মানুষ

মানুষের পেটে নেই খানি, ঘরে নেই ছানি, মরছে মাছ

পেটে নেই খানি, ঘরে নেই ছানি। এর মধ্যে মরছে মাছ, বাড়ছে আহাজারী, কাজের সন্ধানে মানুষ ছাড়ছে বাড়ী। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে এমনি এক দুরাবস্থা। একদিকে মানুষ ফসল হারিয়েছে, অপরদিকে হাওর নদীতে মাছ মরছে। ফসল ডুবার পর এখন মাছে মড়ক দেখা দিয়েছে। হাওর নদীতে- মাছের মড়ক দেখা দেয়ায় অভাবী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। মৎস্যজীবীরাও নিরুপায়। হাওরাঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার আর কোন অবলম্বন নেই। দেখা দিয়েছে দারুণ অভাব। এলাকায় কোন কাজও নেই। সকলের ঘরেই অভাব। তাই অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে বাড়ী ছাড়ছে মানুষ।

পাথর, মাছ ও ধান ছিল সুনামগঞ্জের মানুষের প্রাণ। কিন্তু এবার ধান গেল, মাছও গেল। সব হাড়িয়ে এখানকার মানুষ প্রায় নিঃস্ব। এ জেলার হাওরের ৮০ ভাগ ফসল ইতোমধ্যে ডুবে গেছে। এখন মাছে দেখা দিয়েছে মড়ক। হাওরের ধান গাছ পচে হাওর -নদীর পানি হয়েছে একাকার। পানি হয়ে পড়েছে বিষাক্ত। হাওর- নদীতে মাছ মরে ভেসে ওঠছে। গত কয়েকদিন থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকার নদী ও হাওরে নানা প্রজাতীর মাছ মরছে। মাছ ধরে জীবন চালানোর উপায়ও নেই হাওরাঞ্চলের মানুষের। কৃষকসহ প্রায় সকল মানুষই পড়েছেন দারুণ অভাবে। তাদের হাতে নেই টাকা। ঘরে নেই খানি। ঋণের বোঝা মাথায়। মাছ মরে যাওয়ায় হাওর এলাকার মানুষ পড়েছেন আরো বিপাকে। বাঁচার কোন উপায় না থাকায় দিশেহারা হয়ে বাড়ী ছেড়ে কাজ খুঁজছেন ভাটি অঞ্চলের মানুষ। জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছুটে যাচ্ছে অভাবী মানুষেরা। জামালগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম কালীপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম জানান তার চাচাতো ভাই আলী আহমদ, ভাতিজা সুহেল, কবীর অভাবের তাড়নায় বাড়ী ছেড়ে কাজের সন্ধানে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর চলে গেছে। এ ছাড়া উপজেলার মামনপুর, লম্বাবাক, সদর কান্দি, কামিনীপুর, বেইলী ইউনিয়নের ইনাত নগর, বদরপুর, আলীপুর, হরিনাকান্দি, আহসানপুর, হিজলা গ্রামের অভাবী মানুষরা অভাবের তাড়নায় বাড়ী ছেড়ে কেউ ঢাকায়, কেউ সিলেটের জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জের পাথর কোয়ারীতে কাজের সন্ধানে চলে গেছে।
জামালগঞ্জের ভাটি বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম ইনকিলাবকে বলেন ভাটি এলাকার মানুষ ধান হারিয়ে এখন নিঃস্ব। কিভাবে বাঁচবে এমন দুর্ভাবনার মধ্যে দেখা দিয়েছে মাছে মড়ক। এ ক’দিনে মাছ মরে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের বোঝা তাদের মাথায়। এখন মাছ মরছে। হাওর-নদীতে মাছ নেই। গরীবদের মাছ বিক্রি করে জীবন বাঁচানোরও কোন উপায় নেই। সরকারের ১০ টাকা কেজির ও খোলা বাজারের ১৫ টাকা কেজির চাল সকল অভাবীরা পাচ্ছে না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ নিতান্তই কম। তাই দেখা দিয়েছে প্রকট অভাব। তিনি আরো বলেন, জামালগঞ্জে খোলা বাজারের চাল সংগ্রহে করতে গিয়ে অনেক অভাবী মানুষ পুলিশের লাঠিচার্জেও পড়েছেন। ফসল বিনষ্টের পর, এখন হাওর নদীতে মাছ মরে যাওয়ায় বাঁচার তাগিদে গ্রামের অভাবী মানুষেরা কাজের খোঁজে ঢাকায় ও গাজীপুরসহ সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারীতে যাচ্ছেন। ফেনারবাক ইউনিয়নের শান্তিপুর, বিজয়নগর ও সেলিমগঞ্জ গ্রামের মানুষ বাড়ীঘর ছেড়ে বাঁচার লড়াইয়ে ছুটে যাচ্ছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায়। মধ্যনগর থানার শানবাড়ী গ্রামের সাইদুল জানান হাওরের ফসল ডুবে যাওয়ায় ধান গাছ পচে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। পানির রং চেইনঞ্জ হয়ে গেছে। গত বুধবার হাওরের পানি খেয়ে পেট ফুলে তার একটি গাই গরু মারা গেছে। এ ভয়ে তিনি তার অপর ৩টি গরু মোহনগঞ্জ এলাকায় দিয়ে এসেছেন। গরু বিক্রি করলে প্রকৃত দাম পাওয়া যায় না। একই গ্রামের আলমগীর মজুমদার জানান বানারশিপুর, গিরইল, রাজাপুর, বড়ই, শরশতিপুর ও হরিপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজন অভাবে পড়ে সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রামের দিকে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল করিম জানান ইউনিয়নের বেশ কয়েকহটি গ্রামের মানুষ এবার ফসল হারিয়ে মারাত্মক অভাবে পড়েছে। অপরদিকে হাওরে মাছও মরে শেষ। এখন কী উপায়ে এ এলাকার মানুষ বাঁচবে, তা তাদের জানা নেই। সরকারের খোলা বাজারের চাল সরবরাহও কম। তাছাড়া ১০ টাকা এবং ১৫ টাকা কেজির চাল কেনার সামর্থ নেই অনেকের। মাছ মরে যাওয়ায় গরীবদের বাঁচার উপায় রইলো না। তারা বাঁচার তাগিদে কাজের সন্ধান করছে। এলাকায় কোন কাজও নেই। অনেকে লজ্জা শরমে অন্যের বাড়ীতে কাজও করতে পারে না। বাড়ী ছেড়ে সুখাইর, কাজিরগাও, ইসলামপুর, দৌলতপুর বেরীগাও, শান্তিপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ অভাবে পড়ে কাজের সন্ধানে বাড়ী ছাড়ছে। বেশীরভাগ মানুষ রাজধানী মুখে হচ্ছে। কোন গামেন্টসে কিংবা শিল্প-কারখানায় কাজের আশায়।
ধর্শপাশা উপজেলার ইনকিলাব সংবাদদাতা মোফাজ্জল হোসেন সবুজ জানান খোঁজ নিয়ে জানা গেছে জয়শ্রী ইউনিয়নের সেকের গাও গ্রামের খায়রুল, আসিক, পলাশ, রিপন আলী উছমান ও জিয়াইর রহমান, বাঘা উচা গ্রামের মজিবুর রহমান ফসল হারিয়ে অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে বাড়ী ছেড়ে ঢাকায় ছুটে গেছেন। এভাবে প্রতিদিনই মানুষ বাড়ী ছাড়ছে অভাবের তাড়নায়। জানা যায়, অকাল বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পর অনেক কৃষকই বর্ষা মৌসুমে হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু গত কয়েকদিনে তলিয়ে যাওয়া সবক’টি হাওরের পানি থেকে পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং পানিতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছসহ জলজ প্রাণিও মরে ভেসে ওঠে।
মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে ওই সব হাওরের তলিয়ে যাওয়া ধান পচে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে। ধর্মপাশা উপজেলার বিভিন্ন হাওরের পানিতে ধান গাছ পচে হাওরের পানিতে মাছ মরে ভেসে উঠার খবর পেয়ে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ধারাম ও কাইঞ্জা হাওরে বুধবার সরেজমিনে উপস্থিত হয়ে ওই দুটি হাওরের পানি পরীক্ষা করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। তারা মনে করেন হাওরে কাঁচা ধান গাছ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তা পচে এমোনিয়া নামের এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়েছে। এর ফলে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। ফলে মাছ মরে পানিতে ভেসে ওঠছে। গত বুধবার বৃষ্টি হয়েছে। এভাবে আরও বৃষ্টি হলে পানিতে মাছ বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করছেন তারা।

https://www.dailyinqilab.com/article/75948/