সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর এলাকায় সুরমা নদীতে গত মঙ্গলবার সকালে আধমরা মাছ ভাসতে দেখে অনেকে মাছ শিকারে নেমে পড়েন। ১০ কেজি ওজনের একটি মাছ আটকা পড়ে জালাল মিয়া নামের এই ব্যক্তির জালে l ছবি: আনিস মাহমুদ
২০ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৬

হাওরে ফসলহানি, ধান ডুবে গেছে। এখন মরে যাচ্ছে মাছ

ভরা বৈশাখে ‘চৈতের নিদান’

 

সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ। ৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের দুই দিকে হাওর। চলতি পথে কাছ থেকে দেখার মধ্যে পড়ে যে হাওর, তার নাম ‘দেখার হাওর’। বৈশাখের এ সময় সড়কপথে যানবাহন চলত ধীরগতিতে। কারণ, সড়কলাগোয়া হাওর থেকে কাটা ধান মাড়াই, শুকানোর কাজ চলে সড়কে। পুরো বৈশাখ এ সড়ক দিয়ে পথ চলতে হতো পাকা ধানের গন্ধ মেখে। এবার ভরা বৈশাখে সড়কপথে নেই সেই দৃশ্য। পাকা ধানে বিস্তৃত থাকার কথা ছিল দেখার হাওর। এখন দেখার মধ্যে শুধু পানি আর পানি। যেন শান্ত এক সাগর।
গত ৩০ মার্চ থেকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে একের পর এক হাওরে পানি ঢুকে ফসল তলিয়ে যায়।
অতীতে চৈত্র মাসে এভাবে ফসলহানির ঘটনা ঘটেনি। আবহাওয়াবিদ ও পানিবিশেষজ্ঞরা এই আগাম ফসলহানির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামরচর গ্রামের কৃষক অমর চাঁদ দাশ বললেন, ‘আমার বয়স ৭২। আমি তো দেখিইনি, আমার বাবার মুখেও এভাবে চৈত্র মাসে কাঁচা ধান হাওরের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কথা কখনো শুনিনি। হাওর এলাকার মানুষ ফসল ঘরে তোলার আগে চৈতের নিদান (অভাব) মোকাবিলা করত। এখন বৈশাখ মাসে পড়েছি নিদানের মুখে।’ ফসলডুবির পরবর্তী অবস্থা নিয়েও নতুন করে উদ্বেগ তাঁর। জানালেন, তিন দিন ধরে হাওর-নদীর মাছ ভেসে উঠছে। কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। মানুষ কী করে বাঁচবে!
শুধু কৃষক অমর চাঁদ দাশই নন, গত সোমবার সুনামগঞ্জের হাওর পরিদর্শন করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও বলেছেন, হাওর এলাকায় অতীতে অসময়ে এভাবে কখনো ফসলহানির ঘটনা ঘটেনি। এবার কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
‘হাওরকন্যা’ হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জকে বলা হয় বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের রাজধানী। হাওরের ওপর নির্ভরশীল জেলার মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে মাছ আর বর্ষার আগের বৈশাখে ফলে একমাত্র বোরো ধান। এই জেলায় এ বছর ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। প্রশাসন বলছে, ৮২ শতাংশ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কৃষকেরা বলছেন ৯০ শতাংশ। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাহেদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, হাওরে এবার ফসলহানি না ঘটলে ধান থেকে ৮ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হতো।
সুনামগঞ্জের দেড় শতাধিক ছোট-বড় হাওরে ফসলহানি হয়েছে। এর মধ্যে বড় ধানী হাওর হিসেবে পরিচিত সদর উপজেলার দেখার হাওর। এই হাওরে জেলার চারটি উপজেলার কৃষকদের জমি আছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার কানলার হাওর, তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর, মহালিয়া হাওর, সমসার হাওর, গুরমার হাওর, দিরাই উপজেলার বরাম হাওর, চাপতির হাওর, শাল্লা উপজেলার সবচেয়ে বড় হাওর ছায়ার হাওর, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর ও মইয়ার হাওর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওর, আঙ্গারুলি হাওর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওর, জামখলা হাওর, দোয়ারাবাজার উপজেলার কনকখাই হাওর, চাতল হাওর, ছাতক উপজেলার চাউলির হাওর, ডেকার হাওর, নাইন্দার হাওর উল্লেখযোগ্য। বড় হাওরের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর, জামালগঞ্জের পাকনার হাওরের ফসল স্থানীয় কৃষকদের চেষ্টায় টিকে আছে।
হাওরে ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে দেড় হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ করে পাউবো। এবার ৪২টি হাওরে ঠিকাদার ও স্থানীয়ভাবে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ করেছে তারা। বাঁধের কাজের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু কাজ শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ফসল ডোবার আগ পর্যন্ত কোনো ঠিকাদারই শতভাগ কাজ শেষ করেনি। আবার ১২টি বাঁধের কাজ শুরুই হয়নি।
গত মঙ্গলবার দিনভর সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাওরে ঢল আসে সাধারণত মধ্যবৈশাখে। তখন কৃষকেরা খেতের ধান গোলায় তোলায় ব্যস্ত থাকেন। দুই-তিন বছর পরপর হাওরে ফসলহানি ঘটে, তবে পুরো ফসল কখনো তলিয়ে যায় না। ঢল এলেও মানুষ যা পারে চেষ্টা করে গোলায় তুলতে। এবার হাওর থেকে একেবারেই শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাদের।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরপারের নীলপুর গ্রামের কৃষক আছদ আলী (৬৫) জানান, এই হাওরে ৪ এপ্রিল বাঁধ ভেঙে ঢলের পানি ঢুকে ফসল তলিয়ে যায়। আর ১০-১৫ দিন সময় পেলেই ধান পেকে যেত। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই সব শেষ হয়ে যায়। তাঁর পাশে থাকা নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ই-বার অত আগে কেন পানি আইল সেইটা দেখা দরকার। বৃষ্টি তো এর আগেও অইছে, ঢলও নামছে, কিন্তু অত পানি কোনো সময় অইছে না।’
ধানের পর যাচ্ছে মাছও
পানির নিচে কাঁচা ধান পচছে। উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে আশপাশ এলাকায়। হাওর ও নদীর পানি দূষিত হয়ে মরছে মাছ। হাওরপারের ফসলহারা মানুষ মাছ ধরে চলবে, সে আশাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর হাওর এলাকায় দেখা দেবে মাছের আকাল। তাই মাছ রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার দাবি উঠেছে।
গত শনিবার রাতে সুনামগঞ্জে ঝড় হয়। এতে হাওরে ঢেউ ওঠে এবং বাতাসে ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে হাওরে-নদীতে মাছের মড়ক দেখা দেয়। এসব মাছ স্থানীয় লোকজন ধরে খাচ্ছেন আবার বিক্রিও করছেন। যদিও মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে দুটি উপজেলার মাইকিং করে এসব মাছ না ধরতে এবং না খেতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টিকে কেউ আমলে নিচ্ছে না।
সুনামগঞ্জ শহরতলির নবীনগর এলাকায় সুরমা নদীতে গিয়ে দেখা গেছে, মানুষ দল বেঁধে নদীতে ভেসে ওঠা মাছ ধরছেন। ছোট-বড় সব ধরনের মাছ আছে। অনেকেই বস্তা ভরে মাছ নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। আবার কেউ কেউ সেই মাছ বিক্রি করে দিচ্ছেন কম দামে। নবীনগর এলাকার বাসিন্দা আরজু মিয়া প্রায় ১৩ কেজি ওজনের একটি আইড় মাছ হাত দিয়ে ধরেছেন। মাছটি তাঁর হাতে থাকলেও তেমন নড়াচড়া করছে না। মাছটি খুবই দুর্বল। আরেকজনকে দুটি আধা কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ধরতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বাউশ, রুই, বোয়াল, বাইম, চিংড়িসহ সব ধরনের মাছ ধরা পড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দা হিরণ মিয়া বলেন, ‘মাছ তো পাগল অইগেছে। পানিত থাকত পারে না। বাঁচার লাগি পাড়ে আইয়া ভিড়ে আর মানুষজন সেগুলো ধরছে। মাছগুলা দুর্বল অইগিছে।’
‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের সদস্যসচিব বিন্দু তালুকদার বলেছেন, ‘হাওরের পারের ফসলহারা মানুষের শেষ ভরসা ছিল মাছ। এখন সেই মাছও মরে যাচ্ছে। ফসলও নেই, মাছও নেই। এখন হাওরের মানুষের কী হবে! তিন দিন ধরে হাওরে মাছ মরছে কিন্তু মাছ রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি।’
জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শংকর রঞ্জন দাশ বলেন, সুনামগঞ্জের সব হাওর-নদীতেই মাছ মরছে। বিশাল হাওর এলাকার এই সম্পদ রক্ষায় কী করণীয়, সেটাই ভাবনার বিষয়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এই টাকায় দুই দিন জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার দুটি হাওরের কিছু অংশে চুন কিনে ছিটানো হয়েছে।
তবে শুধু চুন ছিটিয়ে প্রতিকার সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড হাওর অ্যাগ্রিকালচার বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ নূর হোসাইন মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শুধু ধানগাছ পচে নয়, সেই সঙ্গে জমিতে ব্যবহার করা কীটনাশক এবং রাসায়নিক সারের মিশ্রণের ফলে পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। এতে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। মাছ অক্সিজেন নিতে না পারায় মরে যাচ্ছে। এর দ্রুত সমাধান হচ্ছে পানি সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু বিশাল হাওরে সেটাও সম্ভব নয়। তাই সরকারের উচিত হাওর এলাকায় দ্রুত বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়ে সমাধান খোঁজা।
চেরাপুঞ্জি নয়, আসামের বৃষ্টি
পৃথিবীর বৃষ্টিবহুল অঞ্চল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের চেরাপুঞ্জির পাদদেশ পড়েছে সিলেট অঞ্চল। অতীতে যেকোনো বছর চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির প্রভাব সিলেট অঞ্চলে পড়ে। এবার চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি নয়, এসেছে আসামের বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, অতীত রেকর্ড হচ্ছে, চেরাপুঞ্জির প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। এবার আসামে অতিবৃষ্টি হওয়ার কারণে সিলেটের জকিগঞ্জ হয়ে বরাক এলাকায় পাহাড়ি ঢল নেমেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা হয়ে সুরমা নদীতে ঢল নামায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পাউবো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই বলেন, শুধু বাঁধ ভেঙে নয়, বাঁধ উপচেও পানি ঢুকেছে হাওরে। যেসব বাঁধ ভেঙেছে, সেগুলো নির্মাণে গাফিলতি আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে আশঙ্কার বিষয় আবহাওয়া পরিস্থিতি।
পাহাড়ি ঢল সৃষ্টির কারণ বৃষ্টি। অকালে ও অসময়ে এই বৃষ্টি এসেছে। এটাকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে মনে করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদেরও বদলাতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যাদেশের সময়সূচিতেও পরিবর্তন আনা দরকার।’
ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে ক্ষোভ
এলাকার লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মহিনুর ইসলাম কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৃষ্টি, ঢল যা-ই বলেন, আসল কথা হলো ফসল রক্ষা বাঁধ। এই বাঁধের কাজ সময়মতো না হওয়ায় কৃষকের কপাল পুড়েছে। বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-গাফিলতির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সুনামগঞ্জে কৃষক আন্দোলনের নেতা নির্মল ভট্টাচার্য বলেছেন, অতীতে চৈত্র মাসে কখনো হাওরের ফসল ডোবেনি। তাঁর অভিযোগ, গত ২০ বছরে কখনো সময়মতো বাঁধের কাজ হয়েছে বলে জানা নেই। বৃষ্টি শুরু হলে বাঁধের কাজও শুরু হয়। এতে বাঁধ হয় দুর্বল। আর দুর্বল বাঁধ ঢলের পানিতে সহজেই ভেঙে যায়।


http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1151176/